Monday, December 17, 2018

অমিত সরকার- মৃত শুঁয়োপোকাদের এপিটাফ





ধরা যাক, সেদিনও এমনই রাত, এই ঋতুবদলের মাস। বরানগরের গলি, বন্ধুর সঙ্গে ছোট্ট চায়ের দোকানে বসে কুয়াশার হিম মাখা চা ও বেকারি বিস্কুট। একজন বৃদ্ধ/ প্রৌঢ়/সিনিয়র সিটিজেন এসে পাশের বেঞ্চে চুপ করে বসলেন। এই  বিশেষণগুলোর একটা শব্দকৌলীন্য আছে, যা আমাদের কনভেনশনাল চিন্তাভাবনাকে একরকম   স্ট্রেটলাইন মান্যতা দেয়, ঘাড় ধরে শেখায় সম্মান  করতে। বন্ধু আমার পিঠে হাত রেখে, ফিসফিসিয়ে, ‘চিনতে পারছিস। বাদলদা। বাদল সেন।’ তারপর সরাসরি দোকানীকে, ’এই, বাদলদাকেও একটা চা, খাবেন তো বাদলদা।’ বৃদ্ধ কিছু বলেন না। যেন এই সম্মাননাটা একান্তই প্রাপ্য ছিল তাঁর, অথবা করদ রাজার থেকে যেন  উপেক্ষায় নজরানা  নিচ্ছেন বৃদ্ধ সম্রাট, এভাবেই তাকিয়ে থাকেন  শূন্যের দিকে। “বাদল সেন” শুনেও আমার কিছু মনে পড়ে না, কোন কিচ্ছু। গিগাবাইট গিগাবাইট  স্মৃতির ড্রয়ারে খেলা করে হা হা আকাশ। ফেসবুকে, ইন্টারনেটে কোন এন্ট্রি নেই। আমার বন্ধুবৃত্তের প্রোফাইলে এই ছবি নেই শুধু নয়, তিনি  সেখানে বেমানান, অদ্ভুত। যেন হগওয়ার্টস স্কুল থেকে নির্বাসিত ভোল্ডেমর্ট। কেউ তাঁর নাম নেয় না। এরমধ্যে চা শেষ হতে বন্ধু তাঁর দিকে এগিয়ে দেয় নিজস্ব প্যাকেটের সিল্ককাট । দু আঙুলে গ্রহন করেন, কিন্তু তাকিয়ে স্বীকৃতিও দেন না।  নিজেই  জ্বালিয়ে নেন একটা পুরনো লাইটারে। তারপর একবুক ধোঁয়া ছেড়ে উঠে পড়েন। হাঁটতে হাঁটতে অন্ধকারের দিকে এগিয়ে  যায় ধুসর পায়জামা,  ময়লা রংচটা পাঞ্জাবী। আমি ও বন্ধুর কথামুখ ঘুরে যায় আমাদের একদম ছোটবেলার  সেই  সত্তর,  সেই আগুনঝরা দশকের দিকে আমাদের গল্পের ও  মাথার মধ্যে ঘোরে একটা অলৌকিক মিছিলের কথা।  গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার কথা।  চারু মজুমদার, কানু  সান্যাল, জঙ্গল  সাঁওতালের কথা। প্রেসিডেন্সীতে খুন হওয়া কবি দ্রোণাচার্য ঘোষের কথা বাদল সেনের কথা। রুনু গুহনিয়োগীর কথা। যেসব রূপকথা ও শুনেছিল একদিন এই  মানুষটির সাহচর্যে।  আমি অন্য কারুর কাছে। আমার আগ্রহ বাড়ে। বন্ধু হাসে, বলে,  ‘একটা জিনিস দেখবি ?’ আমরা উঠে হাঁটতে শুরু করি। দেখি  কাছেই গঙ্গার ধারে শনিমন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে  বাদল সেন প্রণাম করছেন। আমিও ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসি।
আবার অন্য কোন দিন রাস্তায় আমার সঙ্গে ওনার দেখা হয় কখনো আর একটি মন্দিরের সামনে প্রণাম করছেন।  আবার কখনো  মসজিদের সামনে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আমার আর সহ্য হয় না। আমার ব্যক্তিগত রূপকথা টুকরো টুকরো  কাচের  বাসন হয়ে ভাঙতে থাকে। এক সন্ধ্যায় আমি ওনাকে চা অফার করি। সিগারেটও। এবং যেহেতু আমার কোন  নিজস্ব দায়ভার বা স্মৃতিদাগ নেই, স্পষ্ট উচ্চারণে প্রশ্ন করি, ‘আপনার কেসটা কি বলুন তো ?  আপনি কী রেনিগেড না সেকুলার  কোনটা হবার চেষ্টা  করছেন এখন ? নাকি আপনি পা থেকে মাথা পর্যন্ত  একজন বিলিভার ? যে ঠাকুর যেভাবে  দাগিয়ে   দেবে, তাদের সবাইয়ের  জন্য খানিক খানিক ফুল চড়ানো একটা সুবিধেবাদী অ্যাপ্রোচ ? আপনার কেসটা কি, ঠিক করে  বলুন তো কমরেড ?’
বৃদ্ধ হাসেন,  সময়কে ভয় পাওয়া হাসি। বলেন, ‘কমরেড‌ ? আমি অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডারে ভুগছি । জানি এটা ঠিক নয়, আমার চিকিৎসার প্রয়োজন। তবু ভুগছি। সততা আর বিশ্বাস হারাতে হারাতে, ভয় পেতে  পেতে আমার চিন্তার ডিসঅর্ডার হয়ে গেছে। আমার সময়টার তো শুধু হেরে যাবার গল্প। সাফল্যের তো কোন  ইতিহাস নেই। তবে আর একটা কথাও বলি কমরেড, তোমাদের পুরো সময়টাও কিন্তু ওসিডিতে ভুগছে। বিশ্বাসহীনতা, প্রত্যয়হীনতার ওসিডি। প্রয়োজন, খুব প্রয়োজন, সবাইয়েরই আজ চিকিৎসা প্রয়োজন।’  
‘হ্যাঁ, বিশ্বাস নেই বলেই তো টিভি সিরিয়াল থেকে রাজনীতি, সবাইকেই আজকাল ধর্ম বিক্রি করে খেতে হচ্ছে।  ভারতবর্ষের গান্ডু মার্কেটে এইটাই  তো এখন একমাত্র টপ সেলিং প্রোডাক্ট।’  দুজনের ব্যক্তিগত পরিচয়ের  দেওয়ালে সেরকম পুরনো গুলির দাগ নেই।  তবু বলতে থাকি, ‘ঋত্বিকের মত করে তো বলতেও পারতেন, আমি কনফিউসড। তারপরে দেবতার কাছে, অথবা   আলিমুদ্দিনে, অথবা নবান্নে বা অন্য কোথাও কপাল ঠুকে প্রার্থনা জানাতে কে আপত্তি করেছিল ? ও হ্যাঁ, গেরুয়াটাও পরে  দেখলে একবার খারাপ হত কী ? এই লাইনে তো আজকাল অনেকেই খেলছে। কাকাও তো গত ম্যাচে নীলসাদা জার্সি পরে খেলে দিল।’     
‘কি জানি কমরেড। কনফিউসন আছে না নেই ? সেটাও ঠিক করে বুঝতে পারি না আজকাল। “অ্যান্টি ডুরিঙে” কি লেখা ছিল এরকম কথা ? এই অ্যান্টিথিসিস। আর সেরকম প্রার্থনাও আজ অবধি কিছু জানাতে পারলাম কী ? বোধহয়  পুরোটাই আমার বা  আমাদের একটা ওসিডি ম্যানিয়া।’          
‘তাহলে, সাতই নভেম্বর অরোরা জাহাজে মাঝরাতে যে ঘোষণাটা হয়েছিল, অথবা লং মার্চ, যাদের নিয়ে আপনাদের  এতো সব ফ্যান্টাসাইজিং, সেইসব স্বপ্নদিনের টুকরো টাকরা তো আপনারা একদিন জমিয়ে  রেখেছিলেন বুকের গভীরে। একসময় চালানও করেছিলেন আমাদের কারু কারুর বুকে। তাতে মরচে ধরে ক্ষয় লেগে, সেই মালটা এখন এক্কেবারে  উবে গেছে। খতম। আর সাতষট্টির পঁচিশে মে’র এসপ্ল্যানেডে সেই রূপকথার মিছিল। সে গল্পটাও শেষ।  বাকিটুকু কাবাড়িওয়ালার কাছে  বেচে  দিয়ে একদম ‘শূন্য এ বুকে পাখি মোর, ...।’ আপনাদের গল্পটা তো এইটুকুই?’
‘কেন সমস্ত রূপকথা খুব দ্রুত ভেঙে গেল ? এই প্রশ্নটার উত্তর আমার কাছেও ঠিকঠাক স্পষ্ট নয় কমরেড। তবে...’
‘তবে মানে ? আপনারই তো বলতেন, “ইতিহাসের দুটো নাম/ নকশালবাড়ি, ভিয়েতনাম।” আপনাদের অভিমুখহীন খতম থিয়োরি, গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার রূপকথা সব ফালতু। একদম রাজারানী, রাক্কস খোক্কসের ছেলেভুলোনো গল্প। শালা আজকাল ভিয়েতনামে ট্রাম্প বউ নিয়ে বেড়াতে আসে। আমরা ভেবেছিলাম, অন্তত  একটা চতুর নাগরালি দলের চুতিয়ামি থেকে আপনারা মুক্ত থাকবেন। আপনাদের স্ট্যান্ড থাকবে, গ্রামে চলো।  হাতে লেগে থাকবে  মাটির দাগ,   ময়লা পাঞ্জাবীতে শ্রমের গন্ধ । ওরা এতো, আমরা  এতোর অহংকারী মূর্খতা নয়,  হাত ধরে টেনে তোলার সমবেদনা। মাঝখান থেকে তারাই চৌঁতিরিশ বছর মধু খেয়ে গেল। আর আপনারা ? এ লাইন থেকে ও লাইনে এক ইঞ্চির সরে যাওয়া নিয়ে তত্ত্ব মারালেন। আপনাদের কী অবস্থান ছিল   মরিচঝাঁপিতে ?  সিঙ্গুরে, নন্দিগ্রামে, ভাঙড়ে কি ছিঁড়লেন আপনারা ? মাঝখান থেকে একটা বিশ্বাস, একটা স্বপ্নের মৃত্যু হল। শুঁয়োপোকাগুলো সবাই সব্বাই মরে গেল। একজনও প্রজাপতি হল না। সব শালা দালাল আর  সুবিধেবাদী। বাল, একটা রূপকথা তো ছিল কারুর কারুর। জানি, বুঝি, সেসব সত্যি হত না কখনো, কিন্তু ছিল  তো  আপনাদের  মত বুড়ো ভামেরাই আমাদের ছোটবেলার রূপকথাগুলোকে ভেঙে দেবার জন্যে  দায়ী। যদি ভেঙেই দেবেন, টিকিয়ে রাখতে পারবেন না, তবে কেন লিখেছিলেন রূপকথাদের ? বলতে পারেন কেন একটা  স্বপ্নের সিস্টেম, একটা গোটা রিপাবলিক, একশো  বছরেরও কম সময়ে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে ? আর যেখানে সিস্টেম টিকে থাকবে, সেখানে সংবিধান সংশোধন করে প্রেসিডেন্ট হয়ে যাবে  আমৃত্যু এক  রাজা, যার  মুখের কথাই আইন। একবারও ভেবেছেন, আপনার সন্তানেরা, তাদের সন্তানেরা কী স্বপ্ন  বুকে নিয়ে বাঁচবে  এরপর ?’ আমার ঠোঁট কাঁপছে আমি বুঝতে পারি। বৃদ্ধ আমার হাতে হাত রাখেন। ঠাণ্ডা কুঁচকনো হাতেও সামান্য উষ্ণতা এখনো লেগে। আমার হাত ধরে টানেন, বলেন, ‘চলো কমরেড, তোমাকে একটা জিনিস দেখাতে চাই’    
আমরা দুজনে অন্ধকার বরানগরের গলি ধরে ধরে হাঁটতে থাকি। আমার মনে পড়ে, একদিনে তিনশো তরুণকে গুলি করে মেরেছিল পুলিশ এই সব গলিতে শুধু একটা রূপকথা বিশ্বাস করার অপরাধে। খানিকটা  হাঁটার পর আমরা পৌঁছই আর  একটা ভাঙাচোরা বাড়িতে। দেওয়াল দেখে বোঝা যাচ্ছে বহুদিন সংস্কার হয় নি। হয়ত মালিকেরা আর কেউ  বেঁচে নেই,  আর এই গলির গভীর জঙ্গলে প্রমোটারেরও নজর পড়েনি। ভেতরে একটা নাইট স্কুল। কয়েকটা বস্তির ছেলেকে পড়াচ্ছে  দুজন  তরুণ ও তরুণী। বৃদ্ধ কিন্তু ভেতরে না ঢুকে আমাকে নিয়ে বাইরের দেওয়ালে কি যেন দেখাতে চান। মৃত বাল্বের আবছা অন্ধকার আমাদের গ্রাস করে রেখেছে, আমি ঠিক বুঝতে পারি না। বৃদ্ধ লাইটার জ্বালেন। দেখি দেওয়ালে পঞ্চাশ বছরেরও আগে  স্টেনসিলে আঁকা রংচটা ছবিতে বিরাট দাড়িওয়ালা মুখ নির্নিমেষ চেয়ে আছে, পাশে টেকো ফ্রেঞ্চকাট স্বপ্ন ফেরী করা রাশিয়ান, আরও কেউ  কেউ একদম আবছা। বৃদ্ধ ততক্ষণে নিজের পাঞ্জাবী দিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করছেন দেওয়ালে লেখা একটি  পুরাতাত্ত্বিক শ্লোগান,  “মেহনতি  মানুষ, ধরো বই। ওটা  হাতিয়ার।” আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। হয়তো এভাবেই রূপকথারা বেঁচে থাকে, গোপনে                                  

No comments:

Post a Comment

এক ঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে