Sunday, December 16, 2018

গল্প- শ র্মি ষ্ঠা






এখানে এখন কেউ থাকে না


সকালে আমায় আর ব্রাশ করায় না সোমাটিনের জিবছোলাটা, যেটার একধারে ফুটোয় একটা সুতলি বাঁধা থাকতো – সেটা হাতে ঠেকেনি অনেকদিন! আগে তো গামলা ধরে মুখ ধুইয়ে দিত সকাল সকাল। তারপরে হাতে ধরিয়ে দিত চায়ের প্লেটটা। গরম কাপের গা ঘেঁষেই থাকতো ঘি বোলানো আধভাঁজ করা দুটো হাতরুটি। সেসব পাট অনেকদিন উঠে গেছে।

আগে এমন সৃষ্টিছাড়া ব্যাপার ছিল না। সকালে খাওয়া দাওয়ার পাট চুকলে অতসীদেবীকে তেল মাখাতে বসত সোমা। দরজায় ছিটকিনির আওয়াজ পাওয়া যেত তার আগে। ঝুলে পড়া চামড়ায় তেল মাখিয়ে, গা মুছিয়ে দিত
গরমের দিনে হেলানো মাথায় গুনে গুনে ঠিক পাঁচ মগ জল  ঠান্ডা হয়ে আসতো তেলোর কাছের দপদপানিটা। চুল আঁচড়ে,সিঁদুর,টিপ পরিয়ে দিয়ে,সেসব দিনে ভেজা গামছাটা হাতের কাছে একটা চেয়ারে রেখে যেত সোমা। দুপুরে, বিকেলে ওটা হাতে মুখে ছুঁইয়ে,ঠান্ডা ঠান্ডা বেশ একটা আরাম হতো।

সন্ধ্যের সময়টায় অতসীদেবী কান পেতে অপেক্ষা করে থাকতেন ছ-আটবারের আনাড়ি চেষ্টায় তিনবার কি ফুঁ পড়ল শাঁখে! জোড় হাত কপাল থেকে নামিয়ে লোভীর মতো পথ চেয়ে থাকতেন তিনি। ঐ যে আনাড়ি জন   তার নাতনী এবার সে ধূপ দিয়ে যাবে ঘরে। তারপর লঘু পায়ে এসে তাঁর খাটে উঠে বসবে পাউডার,চিরুনী, গাডার মেলে। নরম অপটু দুটি হাতে যেমন-তেমন একটা বিনুনী বেঁধে দিয়ে যাবে সেপাউডারের আতিশয্যে ভরিয়ে দিয়ে যাবে বালিশ।

আচ্ছা,নাতনী এখন কত বড়?সোমা বলত,নাতনী ঠাকুমার মুখ পেয়েছে। নিজের বালিকা বয়সের মুখখানি আবার একবার দেখার জন্য এখন মাঝে মাঝে বড় মন কেমন করে অতসীদেবীর।

আরো বেশী করে করে  যখন বুঝতে পারেন, চারপাশের কোনোকিছুই আর তেমন সহজ সোজা নেই এখন খারাপ আয়নার ছবির মতো, তাঁর চেনাজানা অভ্যস্ত দুনিয়াটার আদল একদিনে ভীষণরকম বেঁকেচুরে গেছে। বড় আকস্মিক এ ভাঙচুর। জিবছোলাটার মাঝখানের ঐ ধারালো, মারাত্মক বাঁকটার মতন এ অকস্মাৎ কাউকে রেয়াত করে না, কারো ধার ধারে না।

অতসীদেবীর প্রথম ইন্দ্রিয়টি যাবার পর দ্বিতীয় ইন্দ্রিয়টি ধীরে ধীরে আরও বেশী প্রখর হয়েছে। বহুদিন আজ তিনি কান দিয়ে দেখেন। মেঝেতে পায়ের অল্প আওয়াজে মানুষ চিনে নিতে পারেন। এবাড়ির সকলের চলার ছন্দ জানেন তিনি। পাড়ার যারা বারান্দা পেরিয়ে বাগানের ফুল,কলের জল কিমবা খোঁজ খবর নিতে আসে যায় তাদের পা টানার ধরনেও তিনি সড়গড়। নতুন কেউ এলেও এভাবেই টের পান। তখন ধড়মড় করে উঠে বসার চেষ্টা করেন। পারেন না। সতর্ক গলায় জিজ্ঞাসা করেন,কে এল?শ্বশুরকুলের কেউ কি?মাথায় কাপড় নেই। গায়ের পরিচ্ছদও কেমনধারা ধোওয়া কে জানে! তবে অনেকদিন এসব আর ঘটে না। আজকাল এবাড়িতে আর কেউ আসে না। না পাড়ার লোক,না নতুন কেউ। 

আজ প্রায় সাত আট বছর হলো অতসীদেবী চোখে দেখেন না। প্রথমদিকের হা হুতাশ কমে এলে, না দেখে কাজ করাটা একরকম অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। পেঁয়াজ রসুনের খোসা ছাড়ানো,আনাজপাতি কেটে দেওয়া সবই অনায়াসে পারতেন।শাক বেছে দিতেন,চালের কাঁকর! রোদে বসে বসে নারকোল কুরে দিতেন, পিঠে গড়তেন পৌষের দিনে। বাটাবাটিও এক এক দিন। সোমা সব যোগাড়যন্ত্র করে দিত। তখনও বঁটি পেতে,পিঁড়ি পেতে বসতে পারতেন। এখন সেসব অন্য যুগ,অন্য সংসারের কথা বলে মনে হয়।

সোমাআ! অও সোমাআআ! কোথায় গেলে সব মানুষটাকে ফেলে?কেউ উত্তর দেয় না। বড় বড় ঘর,লম্বা বারান্দার দেয়ালে আছড়ে আছড়ে ধ্বনি প্রতিধ্বনি পরস্পর পরস্পরকে ধস্তাধস্তি করে। তারপর আর কোথাও যাবার নেই দেখে অগত্যা শুয়ে থাকা মানুষটার কানের কাছেই আবার ফিরে আসে। তারপর ফের সব কেমন চুপচাপ হয়ে যায়।  
চোখে দেখি না তাই এতো দুর্গতি!গলাটা নিভে আসতে আসতে প্রায় স্বগোতোক্তি হয়ে যায়।

কিররর-ঢং,কিররর-ঢং। দুটো বাজলো। সাদা কালো গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটা থাকে পাশের ঘরে। সময় পেরোচ্ছে। চারদিক বড়ো নিস্তব্ধ। শুধু ঘড়িটা টিক্ টক্ 
 টিক্ টক্ করে মূহুর্তদের মাথায় টিক দিচ্ছে,কারা কারা পেরোলো! পেটে ভীষণ মোচড় দিচ্ছে খিদে। খিদেয় ঘুলিয়ে যাচ্ছে চিন্তা ভাবনা। এসময় সবচেয়ে কাছের হতে পারতো সোমার দুধভাত আলুসেদ্ধ মাখা হাতটা।

এবার থেকে কি ঘরে আর খাওয়াদাওয়াটুকুও জুটবে না বাপ! এতোও লেখা ছিল কপালে! এতো অবহেলা?কথাগুলো অনুচ্চারিতই থেকে যায়। অভিমানে ইটের মতো শক্ত হয়ে জমে বসে থাকে গলার দুপাশে। উঠে আসতে চেয়েও পারে না।

টিক্ টক্। টিক্ টক্। টিক্ টক্। টিক্ টক্।
রিয়া! তোর মা কোথায় গেল রে-এ?আশেপাশে যে কেউ কোথাও নেই সেটা ভুলে যান মাঝে মাঝে। মনে পড়ে গেলে অভিমানটা তখন রাগ হয়ে বিস্ফোরন ঘটাতে চায়
তোরা কি সব মরে গেলি! 
কালিমন্দিরেই চলে যাই তবে,না কি?কাঙালী ভোজন!

রাগেও যখন কোনো কাজ হয় না তখন অবশেষে কান্নায় নুয়ে পড়ে গলা। 
কাঙালিই তো। কেউ দেখে না রে আমায়! কে আর আছে! দুটো কথা বলার লোক নেই। ভালো মন্দ খোঁজ নেবার নেই 

ভাবলে অবাক লাগে। অসুস্হ মানুষটাকে ফেলে সবাই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। অথচ কিছুদিন আগেও সবাই ছিল। গিরীশ,ছেলে,বৌ,নাতনি। ছেলে কোয়াটার পেয়ে গেছে নিশ্চয়। এখন তো যাবেই তারা ড্যাংড্যাং করে। সোমাকে নিয়ে যাবার কথাও যেন বলেছিল আগে একবার। কে জানে কবে চলে গেছে। চুপিচুপিই গেছে বলতে হবে। আর সোমা?সে তো এখন নিজের সংসার গুছিয়ে নেবেই
। তাবলে বুড়িটাকে এভাবে ত্যাজ্য করে চলে যেতে হয় রে মা

গিরীশেরও আজকাল গলা পাওয়া যায় না। রোজ যে দুপুর থাকতে হাঁটতে যেত! আর যায় না?গিরীশের হাঁটার আওয়াজ কতদিন শোনেন না।ও বেঁচে আছে তো?সুস্হ আছে তো!

আর তার গয়নাদুটো কি করল? খালি কানে হাত বোলালেন অতসীদেবী। ওরা যাবার আগে বোধ হয় খুলে নিয়ে গেছে।



একটা দুটো তিনটে রাঙা তিল বাঁ হাত বেয়ে উপরে উঠে গেছে,অন্যমনস্ক হয়ে গুনে দেখল সোমা। মায়ের গায়ে,বিশেষত পেটে,পিঠে আর বুকেই যত লাল তিল! পুরোপুরি লালও নয় ঠিক। বরং গাঢ় গোলাপি বলা যায় হাতে মুখে খুব একটা নেই যদিও।

চোখ তুলে তাকায় সোমা খোলা জানালার ওপারে সরু রাস্তায়। ঐ তো সেই রিক্সাটা আসছে। এসে থামবে এ বাড়ির সামনে। এ বাড়ির একতলার ছাদটা নেই এখনো
। ঢালাই হবে এবার এ মাসে। রিক্সার ছাউনির ভেতরে ঐ তো বসে আছে মা,বৌমা। ওরা নামছে। ভাড়াবাড়ি নয়,নিজের বাড়ি। সে আবার কেমনধারা জিনিস,তাই দেখতে এসেছে ওরা।  

মায়ের শখ ছিল বড় বড় ঘর হবে। জমি কিনতে কিনতেই জীবনের চল্লিশটা বছর কেটে গেছে যেমন তেমন করে। অল্প ভাড়ার দু কুঠুরি ঘর
। চার পা হাঁটলে ফুরিয়ে যায়। সেখানেই লক্ষ্মীর পা এঁকে এঁকে ভিটেহীন জীবন। ছেলে তাই বাড়ি করার সময় বড়-বড় জানালা আর দরাজ-দরাজ ঘরের নকশা করেছে 

মা রিক্সা থেকে নেমে বলছেন,
দেখলে বৌমা! আরবার যখন এলুম রাস্তার ধারে কতো দোকানপাট ছিল। আজ কেমন কোথাও কিছু নেই!পথ ঘাট সব যেন ধোঁয়া ধোঁয়া!

সেই শুরু। চোখের ফুলদুটির পাপড়ি ঝরা সেই শুরু। বাড়ি হলো। মা কিছুই দেখতে পেলেন না। হাত বুলিয়ে বুঝলেন দেওয়াল। সামনে হাওয়ায় হাত বাড়িয়ে হেঁটে বুঝলেন ঘরের দৈর্ঘ্য প্রস্হ
। বিকেলে পুবের হাওয়ায় জানালার শিক ধরে দাঁড়ালেন। প্রসন্ন মুখে সন্ধ্যেকে প্রদীপ দেখালেন। তারপর ধীরে ধীরে বাড়ি মুখস্হ হয়ে গেল। চৌকাঠের উচ্চতা,চৌবাচ্চার গভীরতা। 

তখনও যদি অপারেশনটা করিয়ে নেওয়া যেত! ডাক্তার বললেন সারভাইভালের চান্স আশি ভাগ। রিস্ক নেওয়া যেত কিন্তু অতসীদেবী পিছিয়ে গেলেন।
মরব, সজ্ঞানে মরব। নিজের চেনা লোকের কাছে। অপারেশন টেবিলে অচেনা লোক ঘেরাও হয়ে মরতে পারব না

মা অসুস্হ হবার পর থেকে সোমাদের ঘরটায় বড় খাটটার পাশে একটি সিঙ্গল খাট ঢোকানো হয়েছে। তারপর থেকে ওইটুকু জায়গার মধ্যেই আটকে আছেন মা বছরের পর বছর। অন্য ঘরটায় থাকেন বাবা। বাগান নিয়েই থাকেন সারাদিন। মাঝে মাঝে ছোটো স্টীলের বাটিতে করে মায়ের খাটের পাশে রেখে যান বেলি,জুঁই,সাদা গোলাপ,যেদিন যেমন।

পাড়া প্রতিবেশী অনেকে গায়ে পড়ে শুনিয়ে গেছে, ব্রেন টিউমার শেষ দশায় কেমন করে বার্স্ট করে! কি ভীষণ কষ্টকর হয় শেষের দিনগুলি। সোমার বড় মন কেমন করে। এই কি পক্ষাঘাতের বয়স! একটি চুলও পাকেনি। একটি দাঁতও পড়েনি। প্রশান্ত মুখে শয্যায় শুয়ে থাকেন। অন্ধ মানুষের দৃষ্টি বড় উদাস। সেখানে কোনো আলোড়ন নেই। আলোর আসা যাওয়া নেই। ব্যক্তি বা বস্তুর অবয়ব নেই। দীর্ঘ অনভ্যাসে সেখানে মনের ছায়াও পড়ে না আর। আনন্দ,দুঃখ,চিন্তা,ভয়,রাগ কোনো অনুভূতিই চোখ অবধি আর পৌঁছয় না। পৌঁছনোকে বাতুলতা মনে করে
 খালি জোড়া ভুরুর মাঝের ঘূর্ণীটি একরকম ঘুরে চলে



চোখ খুলে আর বন্ধ রাখায় তো কোনো পার্থক্য নেই! কানের কাছে পোঁ পোঁ করে একটা মশা উড়ছে। বাথরুমে কোথাও জল পড়ছে টপ্ টপ্। জিভ শুকনো লাগছে। আজকাল, যখন তখন খালি জলের কথা মনে হয়। সাগর-ডিঙাডিঙি খেলার খেলুড়িদের মতো পা বাড়িয়েই থাকেন অতসীদেবী। ঢেউরা গোড়ালী ছুঁতে-ছুঁতে, হাঁটু, জানু, কোমর, বুকে উঠে আসে আবার পিছনে সরে যায়। বালি পড়ে থাকে শুধু।

বালির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে মরীচিকার মতো কেঁপে কেঁপে ওঠে একটি ছবি নদীর ধারে একটা চড়ুইভাতির ছবি স্পষ্ট হয়। ডুরে শাড়ি পরে যেখানে বালিকাটি উবু হয়ে বসে নদীর চরে। আঙুল ডুবিয়ে খুঁড়ে খুঁড়ে তোলে ভেজা বালি হাঁটুতে থুতনি রেখে, একমনে দেখে খেলনা পুকুরের চারদিক চুঁইয়ে ধীরে ধীরে জল আসে কেমন! তলানির এইটুকুন জলে হাত ভিজিয়ে চোখে মুখে, দু হাতে বুলিয়ে নেয় বালিকাটি। এখনো তার চানে যেতে দেরী আছে।

হঠাৎ নদীর ধার কাঁপিয়ে ডেকে ওঠে কুকুরটা। বালিকাটি ভিতু চোখে ঘুরে তাকায়। আর আওয়াজটা আলতো একটা ঠেলা দেয় ছিপছিপ ছোটোখাটো বালিকাটিকে। টাল সামলাতে না পেরে শুয়ে পড়ে বালিকাটি। মূহুর্তকালের মধ্যে নদীর ভেজা বালি হয়ে ওঠে অয়েলক্লথের পিচ্ছিল গা।

অতসীদেবী সটান ফিরে আসেন এঘরের একলা খাটে। কুকুরটা সেই থেকে ডেকেই চলেছে। এটাকে নিয়ে যায় নি কেন? নেড়ি বলে! সমানে চেঁচাচ্ছে কিছুক্ষণ ছাড়া ছাড়া। আগে এতো চেঁচানি বিরক্ত লাগতো। এখন ভালোই লাগে। যাক্,কেউ একজন তো আছে!

খিদে আর পায় না তেমন
 তবে জিভ মাঝে মাঝে লোভী হয়ে ওঠে। একদিন খালি টুমুর কলাই খেতে মন যাচ্ছে। তাঁতীপুকুরের পাড়ের জমিটায় একটা ঝাঁকড়া গাছ ছিল না?গা ভর্তি রোদে তার ঝমঝম করত কালচে সবুজ শুঁটিগুলো। আর তাদের আলতো রোঁয়া রোঁয়া গা! নখ খুঁটে ঢাকনা সরালে ভিতরে পরপর থাকতো সবুজ কলাইগুলো। খুব মিষ্টি কিছু না কিন্তু কি এক অপূর্ব স্বাদ,কি এক গেছো গন্ধ ছোটোবেলার - একগোছা টুমুর কলাই কেউ যদি হাতে এনে দিত এখন?

রোজ চিৎকার করে করে গলার পাশটা কেমন ধরে গেছে
 আর ডাকাডাকি সয় না। চুপচাপ ব্লাউজটা খুলে আস্তে আস্তে সরিয়ে রাখেন বালিশের নীচেকেউ নেইই যখন আশপাশে, এসব বাসি জামাকাপড় আর কদ্দিন পরে থাকবেন!

চোখ বুজে থাকতে থাকতে তন্দ্রা মতো আসছে আবার
 এই তন্দ্রার ভিতরে একটা পুকুর আছে। তালগাছে ঘেরা  তালপুকুর। এই পুকুরটি অতসীদেবীর একার। এখানের জলে দৃশ্যর মায়া কাজ করে না। আকাশ, ঝুঁকে পড়া গাছ, পাখি কোনো কিছুরই ছবি তৈরী হওয়া নিষেধ এর ঘষা আয়নায়। এইখানে ঘাটের পাথরে বসে পোরুল ছোবড়ায় পা ঘষছেন তিনি। ডুব দেওয়ার আগে, ঘাটে বসে নিজেকে একটু ঘষে মেজে নেওয়া আর কী! পায়ে ফাটার ভাঁজে ভাঁজে আলতা ঢুকে আছে। ও কি সুন্দর গন্ধ ঝাপটা মেরে যাচ্ছে নাকে! জুঁই

আজ অনেকদিন বাদে স্নান হচ্ছে। তালপুকুরটা বড় হতে হতে ছোটোবেলার শিলাই নদী হয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে
 কিন্তু জল নেই তেমন মাথায় একটু ক্ষার দেবেন কি?এক হাত দিয়ে সাবানের নরম ফেনা ঘষছেন অন্য বাহুতে। কব্জি, হাতের ভাঁজে। প্রসন্ন মনে দুহাত দিয়ে জল কেটে ডুব দিতে গিয়ে দেখছেন তন্দ্রাটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। ডুব দেওয়া যাবে নাজল বড় কম।

এই চলে। খালি তন্দ্রা আর তন্দ্রা। দৃশ্য আর দৃশ্য। কতদিন ভালো ঘুম আসে না। গভীর কালো ঘুম! আলো আসা বন্ধ হবার আগের যত আলো ফিরে ফিরে কালো পর্দায় হানা দেয়। ঘনিয়ে আসা মেঘের মতো একটু ডুবজল অল্পের জন্য হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে বারবার

বাগানের দিক থেকে মৃদু হাওয়ার সুবাস দমকে দমকে খাটের মানুষটার কাছে এসে ভেঙে পড়ছে।এতো ফুল ফুটল - এতো ফুল ছেড়ে ঘরের লোকগুলো সব গেল কোথায়?কি এমন ঘটল?যুদ্ধ! মহামারী! হতেও পারে। তিনি তো আর খবরের কাগজ পড়েন না এখন! দিনদুনিয়ার খোঁজও রাখেন না
 



গতকাল অতসীদেবীর সুগার বেশ বেড়ে গিয়ে থাকবে মনে হয়। লোডশেডিং ছিল সন্ধ্যেবেলা। ছাদে অনেকদিন পর মেয়ের সাথে একটু হাওয়া খেতে গিয়েছিল সোমা। কারেন্ট এলে নীচে নেমে এসে দেখে - পায়ের পাতায়আঙুলের গলিতে গলিতে লাল পিঁপড়ের চওড়া স্রোত। উপরের দিকে উঠছে তারা ক্রমশ আরও চওড়া হয়ে। কোনো হুঁশ নেই মায়ের। এরপর অনেকক্ষণ চলেছে তুলো,কেরোসিন আর ছত্রভঙ্গ পিঁপড়ের চতুর্দিক ছোটাছুটি। অনেক যুদ্ধ আর অগুনতি কামড়ের পর,পা থেকে তাদের ছাড়ানো গেছে 

অথচ যাকে ঘিরে এত কিছু ঘটনা, তাঁর কোনো হেলদেল নেই। প্যারালাইজড এদুখানা পা, কোনোভাবেই আর তাঁর নয় নিজের আলতা-পাদুটি, তিনি তো প্রায় রোজই যত্ন করে ঘষামাজা করেন  কোনো এক না-নদী, না-পুকুর সময়ের ঘাটে!

বাড়িতে ডাক্তার এলে কিছু না হোক একটু ভরসা হয়।মফঃস্বলে রোগীর চাপ অনেক বেশী। বাড়ির ভিজিটে সহসা কেউ আসতে চায় না
। রিয়ার বাবা বলে কয়ে ডাক্তারবাবুকে হপ্তায় দুবার করে দেখে যেতে রাজি করিয়েছেন।
মুখে কিছুই দিচ্ছেন না ডাক্তারবাবু কাঁপা গলায় এখন একটু সাহস এসেছে সোমার।
এমনি কি বুঝছেন আপনি?কথা টথা বলছেন কিছু?সেন্স থাকছে? স্যালাইনে ইন্জেকশন পুশ করতে করতে জিজ্ঞেস করলেন ডাক্তার। 
কোথায়?সারাদিন ঘুমে তলিয়ে থাকেন। মুখে জলটুকুও দিতে পারি না। রাতে কি সব বিড়বিড় করেন মাঝে মাঝে। মুখে কান পেতে শোনার চেষ্টা করেছি। কিছু বোঝা যায় না অতসীদেবীর হাতের ফুলে থাকা সবুজ নীল শিরাগুলোর দিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় বলে সোমা

সোমার এখনো বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে,যে এ অবস্হাতেও মা সজ্ঞানেই আছেন শুনতে পাচ্ছেন। ভাবতে পারছেন। এক একদিন মায়ের চোখের পাশে গড়িয়ে পড়া জল দেখেছে সে ভোররাতে। সেটা কতদূর শরীরের কষ্টে আর কতদূর মনের কে জানে!

ডাক্তার চলে গেছে। তার অল্পক্ষন পর,মা! একটু কিছু মুখে দিন’–কানের কাছে মুখ নামিয়ে এনে অনুনয় করল সোমা খুবই অল্প দুধ ভাত কাঁচাপোস্ত দিয়ে মেখে এনেছে সে। ছোটো প্লেটে করে। মাছ আনার সাহস পায় নি। আশা খুবই কম।
একটু দুধভাত - খাবেন? মাছবাটিও আছে। সরষে দিয়ে বানিয়েছি। ঝাল ঝাল আপনি ভালোবাসেন তো? যথাসম্ভব লোভ দেখায় সোমা। কাজ হয় না। 

যেভাবে দাঁতে দাঁত চেপে আছে মানুষটা মনে হচ্ছে এ অনশন ভাঙার নয়। অঘোরে ঘুমন্ত মানুষকে কি আর খাওয়ানো যায়? চামচ দিয়ে দাঁত ফাঁক করে একটু একটু করে দুধ দেবার চেষ্টা করল সে। নাহ্। এভাবে পড়ে যাচ্ছে। ঢোঁক গেলার কোনো চেষ্টাই নেই। 

বোতলে করে একবার চেষ্টা করে দেখবে! সোমার মন বলছে বোতল হলে হয়তো খেয়েও নিতে পারে। বয়স্ক মানুষের মন শিশুর থেকে খুব কি আলাদা!কে জানে,হয়তো মায়ের স্তন ভেবে ভুল করেই হাঁ করে ফেলত। রিয়ার ছোটোবেলার জিনিস পত্র সব যদ্দুর মনে পড়ে শোকেসের নীচের খোপটার পেছনদিকে ছিল। খুঁজে বার করে ফুটিয়ে রাখতে হবে বোতলটা।

বেডপ্যানে ব্যথা লাগে কোমরে তাই রিয়াকে ছোটোবেলায় যেমন নরম কাপড়ের ন্যাপি পরিয়ে রাখত,তেমনি পরিয়ে রাখে এখন মাকে। খারাপ লাগে। ধোওয়া কাপড় পরা,পরিস্কার পরিচ্ছন্ন মানুষটা ল্যাঙট পরে থাকে আজকাল! বাবার সাদা ধুতি কেটে অনেককটা অমনি তেকোনা ল্যাঙট খুব সঙ্কোচে বানিয়েছে সোমা। কোমর তুলে সরাতে নড়াতে প্রথমদিকে ভারী লাগতো। এখন আর লাগে না। গা স্পঞ্জ করার পর বেডসোরের ড্রেসিং মিটলে, ল্যাঙট আর ব্লাউজ পরিয়ে লাল পাড় সাদা শাড়ি দিয়ে গা ঢেকে দিলে মাকে এখনও কতো ভালো লাগে।

পরের মেয়ের জন্য অতসীদেবীও তো কম কিছু করেননি। কি করে ভুলে যাবে সোমা! খরমুখ শ্বশুরের কাছ থেকে, বরাবর আড়াল দিয়ে রেখেছেন ভিতু মেয়েটিকে ঝড়ঝাপটায়, মা পাখির মতো ডানা মেলে আগলেছেন। রান্না ভালো হলে বলেছেন,সোমা করেছেঅপটু হাতে নুনে পোড়া হয়ে গেলে তড়িঘড়ি নিজের দোষ বলে ঢাকা দেবার চেষ্টা করেছেন। আজকাল এসব বড় বেশী মনে আসে আর উদাস হয়ে যায় সোমা।

একটু আঙুল কি ঠোঁটের নড়াচড়া, একটু বিরক্তির ভ্রুভঙ্গীর জন্য হাপিত্যেস করে বসে থাকে সোমা তার জানতে ইচ্ছে করে, এই দিনরাত্রি সেবার কতটুকু পৌঁছচ্ছে মানুষটা অবধি? শিশুর দেখভালে তার হাসিমুখ, দুএকটি নতুন কথা সারাদিনের সব ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়। কিন্তু এখানে এমানুষটা, না বলে কথা, না তাকায় আর না শোনে! মাঝে মাঝে সোমার মনে হয়, একটা ফাঁকা নীল অয়েলক্লথের সামনে বোধহয় একা-একাই নার্স নার্স খেলে সোমা। আসলে এখানে আর কেউ থাকে না।




স্নান তো হলো না। এদিকে বড় ক্ষিদে। ক্ষিদে কমাবার একটা উপায় অবশ্য আছে। সময়ের কুঁজোর ঢাকা সরিয়ে গভীরে নামা। নামেন অতসীদেবী। ধীরে ধীরে সাবধানে। বড় যত্নের অগোছালো স্মৃতি এসব অসময়ের জন্যই তো তুলে রাখা! স্মৃতির রোমকূপ, রন্ধ্ররা খুলে গেলে এই তপ্ত দিনকালে বড় আরাম লাগে।

খাওয়া হয়ে গেছে গিরীশের। আর বাতাস লাগবে না, এইমাত্র হাত নেড়ে জানাল সে ভেজা চুল পিঠে ছড়িয়ে কিশোরী মেয়েটি, দুপুরে এই খাবার সময়টুকু সামনে বসে ভালো করে দেখে, তার স্বামী মানুষটাকে। ব্যবসার কাজ, ছোটাছুটির। এবার চার মাস পর ঘরে ফিরেছে মানুষটা। ভুঁইয়ে নামিয়ে রাখছে মেয়েটি তালপাখার বাঁট। ঝুঁকে ভাঁজ করে রাখছে লাল ঝালর দেওয়া সবুজ পুতুল-পুতুল আসনটা। নিকোবে পরে। হাত দিয়ে পেটের ভার সামলে এখন ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়েছে সে। বড় মেয়ে এখন পেটে।

কিশোরী অতসীর হাতে ঝকঝকে কাঁসার গ্লাস। ভাতের পাতে জল খায় না গিরীশ। মাটির ভেজা কানা ধরে হেলিয়ে ধরেছে নতুন সংসারের কুঁজো। ঠান্ডা সোনালী জল গিরীশের হাতে এগিয়ে দিচ্ছে অতসী স্মৃতি তো সিনেমার মতন, এতোবার দেখা!

এখনকার অতসীদেবী জানেন, গিরীশ এক নিঃশ্বাসে জলটা শেষ করে ফেলবে। তারপর ধুতির গেঁজে খুলে পান বার করবে একটা। গম্ভীর ভাবলেশহীন মুখে অতসীকে বলবে  এই নাও, মিঠা মশলা আছে খুলে দেখো। আর তারপর সবুজ পাতার মোড়ক খুলতেই উজ্জ্বল হয়ে উঠবে কিশোরীটির মুখ। অমন সুন্দর দুটি সোনার ফুল সারা জীবনে আর কখনো দেখবেন না অতসীদেবী চারদিকে সাতটা করে ঝকঝকে সাদা পাথর। আর মাঝখানটিতে নয়নতারার মতো রাঙা একখানা।

গিরীশ নিজের পয়সায় খালি ওই একজোড়া কানেরই দিতে পেরেছিল।ওই একটা গয়নাই তিনি, এ জীবনে রোজ পরেছেন। এবং ঐ একটা গয়নাই তিনি প্রানে ধরে বন্ধক দিতে পারেননি কখনো। যদি আর না ফেরে!

আহা কতো ভালো সব স্মৃতি। আর কি আছে এ কুঁজোটার ভিতর? ক্ষিদে কমানোর মতো কিছু নেই? সানকিতে ঝাড়াপোড়া চাট্টি ভাত বা নিদেনপক্ষে একটু তামুক! অনেক আগে ছেলেবেলায় লুকিয়ে চুরিয়ে খেয়েছেন মাঝে মাঝে। তারপর বয়সকালেও নিয়েছেন। সংসারের কাজ সেরে ছেলেমেয়েকে দুপুরবেলা ঘুম পাড়িয়ে।

গিরীশ তখন বেপাত্তা দিনের পর দিন। ব্যবসার কাজ,অনিশ্চিত ঘোরাঘুরি। অনিশ্চিত টাকাকড়ি। দুই মেয়ে, এক ছেলে। চারটে খিদের পেট। সবার খাওয়া হলে, হাঁড়ির তলানির অল্প মাড় ভাতের পর, মন আনচান ঠান্ডা করতে তামুকের জুড়ি নেই, জানতেন
। এসব দিনে জেনেছিলেন পেটের খিদে জুড়োতেও তাই।

আহ্। পোড়া তামার মতো কি ঘন রঙ তার! তিন আঙুলের তরিবতে বানানো তামুকের নিখুঁত গুলি, তর্জনীতে করে মুখে ছুঁইয়ে, কি যে সুখ! কাশীদাসীর দুকলি গোঁত্তা দিয়ে উঠে আসছে মনে।
রোদ-পিঠ করে সেই যে দুলে দুলে পড়তো মায়া বৌদি
তৈল বিনা বিভূতি মাথায় জটাভার।
তামুক বিহনে দন্ত সফটিক আকার।।

পরক্ষণেই মনে কেমন খটকা লাগে তামুকই তো পড়তো মায়াবৌদি! না কি তামুল(তাম্বুল)? এখানটায় স্মৃতি একটু ঝাপসা ঠিক ঠাহর হয় না। তবে কি স্মৃতিটাকে এখন ইচ্ছেমতো বেঁকিয়ে নিচ্ছে সে! কে বলে দেবে! অল্পক্ষণ আগের সুখ এখন খানিক অস্বস্তিতে গিয়ে ঠেকে। মায়া বৌদি, ও মায়া বৌদি, কি পড়তে গো? বলে দাও! মায়া বৌদি কোনো কথা বলে না। খোলা চুল হাতে করে গুটিয়ে নিতে নিতে হাসে।



খেয়াল থাকে না তো! আনমনে খুলে ফেলি। খালি মনে হয় হারিয়ে যাবে। তার চে তোমার কাছে থাক কান থেকে খুলে সোমার হাতে তুলে দিতে দিতে বলছিলেন অতসীদেবী।তা সেও প্রায় পাঁচ-ছ হপ্তা হয়ে গেল। মোটামুটি তার দুএকদিন পর থেকেই কথাবার্তা বন্ধ।

সোমার হাতের পাতার উপর রাখা ছোটো জিনিসদুটো সেই শেষবার আঙুল বুলিয়ে দেখে নিচ্ছিলেন তিনি
রঙটা বোধায় গেবে গেছে। না? পরিষ্কার হয়নি তো অনেককাল! একটু ধুয়ে রেখো পারলে। তোমার বাবা দিয়েছিলেন। বলতে বলতে তরুনী বয়সের মতো মুখ টিপে সলজ্জ হাসি হেসেছিলেন। একটি দৃষ্টিহীন মানুষ দুটি ধাতব ফুলকে কিভাবে চোখে হারান, মুঠো সরিয়ে নিতে নিতে টের পাচ্ছিল সোমা।

ইদানিং এ ভাবনাটা বড়ো জ্বালায় সোমাকে। অন্ধ মানুষটার ঐ একমাত্র নিজের গয়না। স্মৃতি বলো,গর্ব বলো,প্রেম বলো,সবটুকু ঐ। আর সেটাই যত্ন করে রাখতে পারল না সোমা

এদ্দিন হয়ে গেল। আর কি খুঁজে পাওয়া যাবে? রানীরঙের পাতলা একটা কাগজে, যেটায় রিয়ার দুধবালা থাকতো, সেটায় মুড়ে তোলা ছিল। আলমারীর ডান মাথার কাছে হাতল দেওয়া ছোটো স্টীলের খোপে। একটু ধয়ে মুছে পরিষ্কার করবে বলে নিতে এসে এসে দেখে নেই! অন্য কিছু বার করতে গিয়ে কি পড়ে গেল

সারা ঘর, খাটের তলা, আলমারীর আশপাশ, বারান্দা, পাপোশ সবকিছু ঝেড়েঝুড়ে তন্নতন্ন করে ঝাঁট দিয়েও কিছু মেলে নি। এখনও প্রায় প্রতিদিনই খোঁজে সোমা। কে জানে, হয়তো ওটা পাওয়া গেছে জানলে যদি দুএকটা কথা বলেন!

আজও এসব ভাবতে ভাবতেই অনেক সকাল ঘুম ভেঙে গেছে তার। অন্যমনস্ক হয়ে, উঠানের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে সোমা। অবিন্যস্ত চুল। ঘুমহীন ক্লান্ত চোখ। ভাবছে কোনখানটা থেকে খোঁজ শুরু করবে আজ! তার আগে উঠোন পেরিয়ে সামনের জমিটায় খালি পায়েই হেঁটে নিচ্ছে দুপা। বাইরে তো বেরোনোই হয় না আজকাল আর।

হঠাৎ চোখ পড়ল আকন্দের ঝাড়টার দিকে। আরে! ওখানটা দেখার কথা তো একবারও মাথায় আসেনি! ঘর-উঠানের সমস্ত ঝাঁটের ধুলো টেনে জড়ো করে ঠেলে রাখা হয় ওই ঝোপঝাড়গুলোর দিকে। রোজকার ধুলো জমে জমে ঝোপের গোড়ায় ছোটো ঢিপিমতন হয়ে আছে। ওখানটা একবার দেখা দরকার।

বৃষ্টি হয়েছে গত রাতে। ভেজা ধুলো মাটি কামড়ে বসে আছে জেদীর মতো। সোমা খালি পায়ে অধৈর্য্যর মতো ভেজা ধুলো সরায়। গোড়ালীকে কেন্দ্র করে মাটির থালা আঁকতে থাকে। ছোটোবেলার মতো। অনেকগুলো থালা আঁকে পায়ের চেটো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। থালাগুলো এ ওর গায়ে লেগে যেতে চায়। 

হঠাৎ কি যেন একটা ঠেকে বুড়ো আঙুলে! ভেজা একটা নুড়ি। পায়ে করে তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিতে গিয়ে দেখে নুড়িটার নীচের মাটি থেকে উঁকি দিচ্ছে রানী রঙা ন্যাতানো কাগজের দেহাবশেষ। 

সোমা দ্বিগুন উৎসাহে পা দিয়ে আশপাশের মাটি সরাতে থাকে। বেশীদূর যেতে হয় না। দেখা যায় রানী কাগজটার পাশেই মাটিতে গেঁথে আছে ফুল দুটি। অল্প চিকচিক করছে সাদা পাথরের দু এক কুচি। বেশীরভাগটাই কাদায় বালিতে মাখামাখি। 

পেস্ট দিয়ে চকচকে করে কানের দুটো ধুয়ে এনেছে সোমা। এতোদিনের ক্লান্তিযাপনের পর হঠাৎই তাকে ছোটো মেয়ের মতো বেশী হাসিখুশি দেখাচ্ছে। এটা পাওয়া গেছে জানলে মা এবার সাড়া না দিয়ে পারবেন না। কানে পরিয়ে দিলে আবার ঠিক আগের মতোই মুখ টিপে হাসবেন। দ্রুত বারান্দা পেরিয়ে যাচ্ছে সোমা। হাতের মুঠোয় ধরে আছে সেই বহু আকাঙ্খিত চমক।

মায়ের ঘরের দরজার মুখ অবধি পৌঁছে দেখে, আকস্মিক চমক এখানেও কিছু কম নেই। দৃশ্যের অভিঘাত সহ্য করতে বেশ কয়েকটা মিনিট ওখানেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় সোমাকে কাউকে ডাকাডাকি, চিৎকার করতেও যেন ভুলে গেছে সে

কখন কোন খেয়ালে অতসীদেবী খুলে ফেলেছেন ল্যাঙটের জটিল গিঁট। গায়ে-হাত-পায়ে,বিছানায়,শাড়িতে, আঙুলে,চুলের সর্পিল রেখায় চতুর্দিকে মেখেছেন ভিতরের অস্পৃশ্য বস্তু। হা ঈশ্বর! এখানেই শেষ নয়, এমনকি দাঁত ঠোঁটের ভাঁজেও! 

আর সোমা আশা করছিল এই মানুষটা নাকি তার ডাকে সাড়া দেবে!

নীচের ঠোঁটটা জোরে কামড়ে ধরে নিজেকে জোর করে সোজা রাখে সোমা। প্রতিবার যেমন হিসি,পায়খানা পরিষ্কার করে পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে দিয়েছে এখনও তেমনি শান্ত ভাবেই পরিষ্কার করছে এই আস্তাকুঁড়। ডেটল,গজ,তুলো,বিটাডিন,বোরিক পাউডার থরে থরে সাজিয়ে নিয়ে বসেছে রোজকার মতো। পুরোনো ব্যান্ডেজ সরিয়ে বেডসোরের পরিচর্যা শেষ করে নতুন করে বাঁধছে ব্যান্ডেজ। কোনো গন্ধই আর নাকে লাগে না। কোনো দ্বিধাই আর দ্বিধা বলে মনে হয় না।

সব একতরফা সম্পর্কের মতো এখানেও চলছে ভীষণ ভাঙচুর। অবহেলা ব্যথা দেয়। কিন্তু তার থেকেও বেশী ব্যথা দেয় উপেক্ষা। মায়ের ক্ষতে ওষুধের প্রলেপ দিতে দিতে আসলে নিজের সেই অদৃশ্য ব্যথাগুলোই সারিয়ে তুলতে চাইছে সোমা। 




রান্নাঘরে খিল তুলে,সাড়ে বারোটা একটায় শুতে আসে সোমা
। অতসীদেবীর দিন শুরু হয় রাত দেড়টা দুটোর পর গলার শির ফুলিয়ে চলে অভাব, অভিযোগ, নিঃশব্দ চিৎকার। তাঁর কাছে আজকাল দিনের দৈর্ঘ্য মোটে দেড়-দুঘন্টা। ভোরের দিকে গলা ভেঙে আসে অতসীদেবীর

চার হাত দূরে পাশের বিছানায় রোজ একটা মানুষ প্রাণপন চিৎকার করছেন। অথচ কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছে না সোমা
। এই মসৃন নিস্তব্ধতাও অস্বস্তিকর। আজকাল অনেক রাতেই ঘুম আসে না সোমার। এপাশ ওপাশ করে। বারান্দার ঝিঁঝিঁ আর মশাদের পিনপিন শোনে। মায়ের খাটের পাশে গিয়ে বসে,দাঁড়ায় মাঝে মাঝে। মুখের কাছে কান নিয়ে গিয়ে শোনার চেষ্টা করে। ভোররাতের আগে ঘুমই ধরে না।

শুক্লপক্ষের রাত এখন শেষের মুখে। দূরে রাস্তার ল্যাম্পের আলো আজ নেই। পূর্ণিমার আশপাশে দুতিনদিন মিউনিসিপ্যালটি থেকে বন্ধ রাখে জ্যোৎস্না ভেসে আসছে পর্দা ঘেঁষে। বালিশ থেকে মাথা সরে গেছে রিয়ার। একেবারে দেয়াল ঘেঁষে শুয়েছে রিয়ার বাবা সারাদিন খাটনি আর ডেলী প্যাসেঞ্জারির ধকলের পর লোকটার আর হুঁশ নেই কোনো। রিয়ার ছোটো শরীরটি বাকী খাটটিকে অথবা চিহ্নের মতো প্রায় দুটি সমান ভাগে ভাগ করে রেখেছে। সোমা তলার দিকের ভাগে বসে সোজা করে শুইয়েছে রিয়াকে সেই কখন। কিন্তু এতটা সময় একটুও ঘুমোতে পারেনি।

আঙুলপেটির দপদপানি যন্ত্রনা অন্ধকারে দেখা যায় না। আঙুলে প্লাস্টিক জড়িয়ে রোজের কাচাকাচি শোধ নিচ্ছে এখন খসখসে আঙুলগুলো অন্ধকার গালে বুলিয়ে সে বঁটির কাটাকুটিগুলো বোঝার চেষ্টা করে।

কদিনের প্রাণান্তকর সেবা যা কিনা সে হাসিমুখেই করেছে, আজ পুরোপুরি কেমন অর্থহীন মনে হচ্ছে। অন্ধের যষ্টি ফস্টি হওয়া তো অনেক দূরের কথা। এখন মনে হচ্ছে এদ্দিন সে খালি মানুষটার গুমুত ছুঁয়েই কাটিয়েছে মানুষটাকে ছুঁতে পারেনি। ধরা ছোঁওয়ার পক্ষে মা যে একটু বেশীই দূরে চলে গেছে, এই আজ সকালেই জেনেছে সে। মনে মনে আজ এতো বিধ্বস্ত সোমা! শরীরে তো রোজই। ঘুম পায়চারি দিচ্ছে কিন্তু সুবিধা করে উঠতে পারছে না কিছুতেই।

অবশেষে, নিজেই নিজেকে ঘুম পাড়াতে বসেছে। আলতো করে চাপড় দিতে শুরু করেছে নিজের হাক্লান্ত কপালে। অভ্যাসবশে মুখে এসে পড়েছে কাজলাদিদির গান। চার পাঁচ বছর অবধি রিয়াকে রোজ ঘুম পাড়িয়েছে এ গান শুনিয়ে। গুনগুন করে প্রথমে আসছে সুর। তারপর সুর বেয়ে বেয়ে এক দু ছত্র করে আসছে কথা।

বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই/ মাগো আমার শোলোক বলা কাজলা দিদি কই
খোলা জানালার শিক উতলে চাঁদের আলো পড়ছে ওদিককার খাটে, ঝিকিয়ে উঠছে অয়েলক্লথ
। রূপার মতো চকচক করছে মেঝের কোনায় বাতিল বেডপ্যান। সাপের মতো দুলছে স্যালাইনের চকচকে সরু ল্যাজ।

গানটা খুব চেনা লাগে অতসীদেবীর। কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে সুরটা! রিয়াকে ঘুম পাড়াতে ওর মা পায়ে করে দুলিয়ে দুলিয়ে গাইতো তখন। পাশে বসে শুনতে শুনতে ঝিম ধরে যেত অতসীদেবীর। সোমার গলাই তো মনে হচ্ছে। সোমা এখানে এই নদীটার কাছাকাছি এল কি করে?



ঘুমের কিনারায় ভারী হয়ে আসছে পা। এই সেই প্রতীক্ষিত সময়। কাজলা দিদির নামের মতো অন্ধকারে চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। এই তো নদীটা ছোটো হতে হতে পুকুর হয়ে এসেছে। এই তো রাতের আকাশ উপুড় করা আছে পুকুরে। ওগুলো কি ভাসছে? নক্ষত্র না জোনাকি! এই তো, এইখানে ডুবজল। এইখানে নামতে হবে।সোমার হাত ধরে নামছেন জলে।

মা-মেয়ে একে অন্যের কাছে সরে সরে আসছে। ঘুমের পুকুরের মধ্যে এই তাদের শেষ আবছা দেখাশোনা। 
লেবুর তলে পুকুর পাড়ে / ঝিঁ ঝিঁ ডাকে ঝোপেঝাড়ে এ যেন এ জগতের দৃশ্যই নয়। এতো অন্ধকার আর থোকায় থোকায় এতো জোনাই অতসীদেবী আগে কখনও দেখেননি এ মূহুর্ত পেরিয়ে যেতে দেওয়া চলবে না অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে সোমা। এবার সোমাকে পিছনে রেখে, জলের নীচের ডুবো সিঁড়িগুলি একটি একটি করে কি সহজেই না নামছেন তিনি। 

একটি বহু প্রতীক্ষিত ঘুম আর একটি করুণ গান ছাড়া কেউ জানতে পারছে না এই আশ্চর্য অবতরণের কাহিনী

No comments:

Post a Comment

এক ঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে