Sunday, December 16, 2018

পাঠ-অভিজ্ঞতা - রিমি মুৎসুদ্দি





                                           একটি কাব্যগ্রন্থ ও কিছু নিজস্ব ভাবনা

গ্রন্থ- ছেড়েছি সব অসম্ভবের আশা, বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশক- আনন্দ পাবলিশার্স
প্রচ্ছদ- দেবাশিস সাহা
দাম-৮০ টাকা


Just when I thought there wasn’t room enough
for another thought in my head, I had this great idea--
call it a philosophy of life, if you will. Briefly,
it involved living the way philosophers live,
according to a set of principles. OK, but which ones?
-(John Ashbery, My Philosophy of Life)


কবিতা কিকবিতা কি একটা দর্শন বা ভাবনা, যা জন্ম নেয় কবির মাথার ভেতর আর সেখান থেকেই একের পর এক নির্মাণ অথবা বিনির্মাণ চলতে থাকে ফরাসি কবি ইভা বনফোয়া-র ব্যাখ্যায়কবিতা কোন বস্তুকে বা দৃশ্যকে প্রকৃত বাস্তবতায় ফেরাতে সাহায্য করে (অনুবাদ আর্যনীল মুখোপাধ্যায়)। নিউইয়র্ক স্কুল অফ পোয়েট্রি মুভমেন্টের স্রষ্টা কবি ফ্রাঙ্ক ওহারা কবিতাকে ব্যাখ্যা করছেন এইভাবে- কবিতা হল একান্ত ব্যক্তিগত কিছু পর্যবেক্ষণযা মূলত তার চারপাশের বস্তুদৃশ্য ও মানুষকে দেখার মধ্যে দিয়ে সম্পন্ন হয়
কবিতা তাহলে একটা যোগাযোগের সেতু। এই যোগাযোগ যেমন কবির নিজের সাথে নিজের অথবা কবির সাথে পাঠকের এক নিভৃত যোগাযোগ অথবা একাধিক মাধ্যমের নিজেদের মধ্যে কমিউনিকেট করা। একে অন্যকে বলতে চাওয়াহয়তবা এযাবৎ বলে ফেলা সমস্ত কথার মধ্যবর্তী স্পেসের বিমূর্তকরণ। যা সোজা স্পষ্ট নয় তাই কি বিমূর্ত?
কবি বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছেড়েছি সব অসম্ভবের আশা কাব্যগ্রন্থটি পড়ে বিমূর্ত না বাস্তব এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে বারবার।  
‘অন্যের অস্তিত্বকে মাথায় ধারণ করে
অন্যের যন্ত্রণায় মিশে কদম বাড়াতে বাড়াতে
নিজেকে ভালবেসে মারা গিয়ে
অন্যের ভালবাসায় জন্মাতে জন্মাতে
ঘাসে লেগে থাকা অন্যের রক্তকে
নিজের বলে ভাবার মধ্যে
পাপ নেইকোনও পাপ নেই।’(নষ্টচন্দ্রা)
এই অংশটুকু পড়ে অনেকের মনে হতে পারে এবস্ট্রাক্ট কোথায়? এটা তো বাস্তব। আর এটা ভাবামাত্রই পাঠক মরে গিয়েও বেঁচে ওঠে। বেঁচে ওঠে নিজেকে ভালবেসেযে ভালবাসা জন্ম নেয়যখন তার চারধারে ঘিরে থাকা কুয়াশার মুখ মুছে একটু একটু করে প্রথম সূর্যের আলো তার মাথায় এসে পড়ে আর ছবিটা আসা মাত্রই শুরু হয়ে যায় কবিতাটির বিমূর্তকরণ। অর্থাৎ একই কবিতা তখন আর বাস্তব থাকে না হয়ত। আরও একটা উদাহরণ দেওয়া যাক, আচমকা চোখের সামনে দেখা কোন ঘটনাদুর্ঘটনা অথবা মৃত্যুকে মানুষ যেমন মাঝে মাঝে নিজের করে নেয়। সেরকমই কবির এই অংশগুলো-
আমি ঘোড়ায় চড়িসাঁতার দিইচালাতে পারি তির-ধনুক আর তলোয়ারশিকার পারিখেলতে পারি দাবা আর লিখতে পারি কবিতাও। কিন্তু এই থকথকে জালিয়ানওয়ালাবাগে মাটির মালসায় দুফেরতা মাটি চাপা নাইটহুড আমি আর বইতে পারছি না…’ (বাবা আমার হাতটা ধরো)
পাঠকেরও চেতনার গভীরে কোথাও আঘাত করে। স্বস্তি দেয় না। কবির কথাগুলো অথবা প্রতিবাদগুলো পাঠকের নিজস্ব প্রতিবাদ অথবা যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়ায়।
‘ছেড়েছি সব অসম্ভবের আশা’ কাব্যগ্রন্থটিতে আটটি দীর্ঘকবিতা রয়েছে। কবিতাগুলো পড়তে গিয়ে দীর্ঘকবিতার নির্মাণশৈলী অথবা সচেতন বিনির্মাণকৃত্রিম অলঙ্কারবর্জিত ভাষার নিপুণতাছন্দ ও মাত্রার দক্ষতা এসব ছাপিয়ে কখনও শব্দেরা হাত ধরে নিয়ে যায় অতীতপুরাণ ও আধুনিকতার সঙ্গমস্থলে।  কবিতাগুলোয় প্রাচ্য ও আধুনিকতা একই সঙ্গে সহাবস্থান করে। ঠিক যেমন বাস্তব আর বিমূর্তকরণ। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।
‘মানচিত্রে মাথাই উধাও তবুও টিকি বাঁধা
গ্রাম- রাজাপুর, বাখরগঞ্জ থানা
ঘর বেঁধে দিই লক্ষ লোকের, না বাঁধি না ছাঁদা
বংশ পরম্পরায় ওইটে মানা

সাতমন তেল পুড়িয়ে যদি না-ই নাচলেন রাধা
বাজাই অশ্রু-সম্বরণের সানাই

দেয়াল ভাঙছে ‘ছত্রিশ-ছাব্বিশ-ছত্রিশ’ ধাঁধার
আমার কাজ তো ইট কুড়িয়ে আনা।’ (বাবা আমার হাতটা ধরো)

কবিতাগুলো পড়তে গিয়ে মাঝেমাঝে মনে হয় যেন এক একটা কোলাজযেন টুকরো ইমেজারি। যে ইমেজারির প্রতিটা অনুষঙ্গে রয়েছে জানলাদরজা। আর যখন সেই জানলা দিয়ে অবাধ্য বাতাস এসে ঢোকে তা যেন বলতে চায় 
-কালবৈশাখী কি আমরা পিছনে ফেলে এসেছি?
-হয়ত সামনে অপেক্ষা করছে।
-আর উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের সংগ্রাম?
-জারি আছে। ছুঁচ ফুটিয়ে দেওয়া প্রত্যেকটা চোখ থেকে
গড়িয়ে পড়া প্রথম রক্তবিন্দুর আলোয় জারি আছে।
………- দু’রাত্রি একদিন
আরো কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক-

দাঁড়িয়ে থাকে পাহাড়-চাপা দিন
চাঁদের মতো স্বপ্ন সরে যায়
রোপওয়ে ধরে পৌঁছে যাই আমি
মোহনা থেকে মোহনায়ছেড়েছি সব অসম্ভবের আশা
আবার একই দীর্ঘকবিতায় কবি বলছেন-
আগুন লাগা ট্রেনের কামরায়
ঝুলতে থাকা তপ্ত চামড়ায়
আঁকব আমি আমার ডিজাইন
রাধাকে ফেলে পালানো শ্যামরায়(ছেড়েছি সব অসম্ভবের আশা)
প্রতিটা দৃশ্য মনের গভীর থেকে উঠে আসা রঙ ছুঁড়ে ছুঁড়ে আঁকা কোলাজ। যেন জ্যাকসন পোলকের আঁকা Yellow Island  অথবা কেনেথ কচ-এর কবিতা Sun Out
বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটা কবিতাই রঙ ছুঁড়ে আঁকা এবস্ট্রাক্ট পেন্টিং অথচ তা ধারণ করে আছে পুরাণ থেকে শুরু করে আজকের সমাজবহু প্রাচীন যুগ থেকে শুরু হওয়া একটা জার্ণি। যা আধুনিকতাউত্তর আধুনিকতা পেরিয়ে এসে পৌঁছেছে এমন এক সময়ে যেখানে নৈবৃত্তিকতা এক রূপকআসলে কঠিন বাস্তবেরই নগ্ন রূপ। আর সেই রুপমুগ্ধতায় আছে প্রেমআছে বিশ্বাস, আছে ভালবাসা আবার একই সঙ্গে আছে মৃত্যুআছে অবিশ্বাসআছে যন্ত্রণাআছে মুক্তিআছে স্বপ্ন। কবির কথায়-
বেঁচে থাকছে সেই স্বপ্নটা
যার কাছে আমরা বন্ধক রেখেছিলাম
আমাদের নশ্বর জীবন
আর ছাড়িয়ে আনতে পারিনি। (সোনা হারিয়ে ফেলার পর)
অথবা কোন একটা দীর্ঘশ্বাস যেন ইতিহাসের পাতা থেকে ফিসফিস করে বলে যায়-
বিদায় নীরবতামৌনতার পাপ
লেগেছে আপনার শরীরে তাই
স্নানের শেষে কোনও সূর্যদেবতাকে
সাক্ষী রেখে আমি বলতে চাই
হিংসা চলমানমৃত্যু ঘটমান,
সকল পরিচিত-আগন্তুক
গড়িয়ে যেতে যেতে তবুও দাঁড়িয়েছে
ছুঁয়েছে ঠোঁট দিয়ে তোমার মুখ  (দু’রাত্রি একদিন)

No comments:

Post a Comment

এক ঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে