Monday, December 17, 2018

শাশ্বতী সান্যাল -- জাংশন আর জলকন্যাদের রূপকথা...






                                  

আসলে সমস্ত গল্পের মধ্যেই একটা রেলপথ শুয়ে আছে।  পুরোপুরি সমান্তরাল নয়, গো-ক্ষুরের মতো একটা বাঁক নেওয়া রেলপথ। আর সেই বাঁকের ঠিক মুখেই একটা নির্জন ইস্টিশান। সারাদিনে তিনচারটে লোকাল ট্রেন যার নীরবতাকে কখনোই পুরোপুরি ভেঙে ফেলতে পারেনা... কয়েকমুহূর্ত গমগম করে উঠেই ফের ঘুমিয়ে পড়ে চরাচর। যেন পাতালপুরীর ঘুমের দেশ। সোনারকাঠি রুপোরকাঠি বদল করে অজগরের মতো সুদীর্ঘ মালগাড়িগুলোকে কেউ সারাদিন ঘুম পাড়িয়ে রাখে সেই ছায়াঘেরা রেলগুমটিতে, কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায়। তাদের চাকায় অজানা সাত রাজ্যের ধুলো। বিম্বিসার অশোকের ধূসর পৃথিবী থেকে হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত তারা বনলতা সেনের পাখীর নীড়ের চোখ কীকরে যেন খুঁজে পেয়েছে এই শান্ত মুখচোরা ইস্টিশানেই।

 আমার নিজস্ব রূপকথাগুলো তো এভাবেই শুরু হয়েছিল। একটা প্রান্তিক রেলস্টেশনের ধারে; ভুতপ্রেত, সাপখোপ, পরী আর রাজপুত্তুরের গল্পে ভরা এক গন্ডগ্রামে... যেখন কারেন্ট চলে যাওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা ছিল। আর একবার ফেজ গেলে তো তিনচারদিনের আগে আলো ফেরার প্রশ্নই নেই। কত যত্ন করে কাপড়ে ঘসে ঘসে প্রতিদিন পরিচ্ছন্ন করা হত কেরোসিন ল্যাম্পের কলঙ্ক... তারপর সেই দুর্দিনের লন্ঠনের আলোয় সন্ধেবেলার উঠোনে দীর্ঘ হয়ে দুলে উঠতো বাতাবি'র ছায়া, যেন ডাকিনীর হাত... মন্ত্র পড়ে পড়ে বাচ্চা ছেলেমেয়েদের সে ভুলিয়ে নিয়ে যায় নির্জন পুকুরপাড়ে, শাপলা আর পানিফলের জঙ্গলে।

এই জলা-জঙ্গলের প্রতি কী যে অমোঘ টান ছিল আমার! মা যতই খোক্কস মাছেদের গল্প বলে ভয় দেখাতে চায়, পদ্মগোখরোর শঙখ লাগার আশ্চর্য ব্যাখ্যান শোনায় চোখ গোল গোল করে, ততই যেন তীব্র হয় আকর্ষণ... আমি মনে মনে ঠিক বুঝতে পারি ভরসন্ধেবেলা ওই পুকুরের পাড়ে, নিমগাছের ছায়াতেই মারমেড এসে বসে থাকে। তারা শাপলা ফুল দিয়ে খোঁপা সাজায় আর কাছাকাছি কেউ চলে এলেই  'ঝুপ'... জলে বুড়বুড়ি কেটে অদৃশ্য হয়ে যায় কন্যে।  শুধু পড়ে থাকে প্রমাণস্বরূপ দুটোএকটা রঙিন আঁশ। পাশের বাড়ির বাবুনদাদা তো দুপুরবেলা আমায় চুপিচুপি ডেকে দেখিয়েছে নীলচেসবুজ সেই আশ্চর্য আঁশ, যা থেকে রাত্তিরে আলো ঠিকরে  বেরোয়। বাবুনদাদা যে মিথ্যেকথা বলে না, সে তো ততদিনে আমি জেনেই গেছি। সেই যে যেবার ঝড়ে একটা চড়ুইছানা বাসা ভেঙে এসে পড়লো ওদের উঠোনে, ও'ই তো তখন চুনহলুদের পট্টি লাগিয়েছিল পাখির পায়ে, আর আমাকে চুপিচুপি বলেছিল ছোট্ট ছানাটা কেমন অল্প অল্প বাংলা শিখে ফেলছে ওর কাছ থেকে। কী পরিস্কার মাথা সেই পাখির ছানার। দুদিন পর দিব্যি শ্লেটপেনসিলও আয়ত্ত হয়ে যাবে... সেসব কথা কি আমি অবিশ্বাস করেছি? নেহাত আট দশদিন পর মা-পাখিটা বাসা সারিয়ে খুঁজতে খুঁজতে এসে ছানাটাকে নিয়ে গেল ইস্কুলে ভর্তি করবে বলে, নাহলে বাবুনদা তো বলেছিলই   যুক্তাক্ষরটা শিখে গেলেই আমার সামনে একদিন পড়া ধরে তাক লাগিয়ে দেবে...

যাক সে কথা, আসলে বাবুনদার মুখে এসব গপ্প শোনার পর  থেকেই রোজ সন্ধেবেলা আমি পড়ার ফাঁকে কান পেতে থাকতাম পুকুরপাড়ে একটা 'ঝুপ্পুস' শব্দ শুনব বলে। ভরদুপুরে, যখন কাজের মাসি মাটির হাঁড়ি ডুবিয়ে আসতো ঘাটের কাছে, পরের দিন ভোরে তেলাকাঁকড়া ধরবে বলে, তখন আমিও পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়াতাম নিমগাছের নীচের আলো-অন্ধকারে... দেখতাম কীভাবে মাছ মুখে নিয়েই রোদ্দুরে উড়ে যাচ্ছে নীলবর্ণ মাছরাঙা, চিল...
 সেসময় সারা দুপুর মায়ের চোখ এড়িয়ে সাত বছরের এক টেপফ্রক কিশোরী একা একা খুঁজে বেড়াতো মারমেডের নীল আঁশ... রোদ্দুরে পচে ওঠা ঝাঁঝির ঝিম গন্ধ যাাকে আবিষ্ট করে রাখতো। উল্টোদিকের পাড়ে আলো করে ফুটে থাকা অজস্র ভাঁটফুলে উড়ে আসত হলুদ রঙের প্রজাপতি। সেদিকে পায়ে পায়ে এগোতে গিয়ে হঠাৎ জল আর জঙ্গলের প্রান্তসীমার ঝোপ নড়ে উঠলেই আচমকা ধ্ক করে উঠতো যার বুক। পরক্ষণেই দেখতে পেত মানুষের পায়ের শব্দ শুনে ছুটে পালাচ্ছে কাচ্চাবাচ্চাসহ সংসারী বেজি, শ্যাওলায় বসে থাকা ধ্যানস্থ কোঁচবক। চৈত্রের দীর্ঘ দুপুর জুড়ে একটা আস্ত রূপকথা এভাবেই তার সামনে একটু একটু করে গড়ে উঠে আবার ভেঙে পড়তো পুনর্নিমাণের ভিতরে...

মারমেড তো দূরস্থান, মারমেডের আঁশও কোনোদিন খুঁজে পাইনি আমি। কিন্তু এই খুঁজে পাওয়ার নেশায় পেয়ে বসেছিল আমায়। স্পর্ধা এতটাই বেড়েছিল যে সাহসে ভর দিয়ে একদিন সন্ধেবেলাতেও হাজির হয়েছিলাম সেই নিষিদ্ধ পুকুরের পাড়ে। দেখেছিলাম নিমের ডালে কীরকম চুপচাপ বসে আছে ফুটফুটে লক্ষ্মী প্যাঁচা... আকাশের আধখানা চাঁদ, না নীচের ঢালু জমিতে মেঠো ইঁদুরের গর্ত, কোনদিকে তার চোখ কে জানে!  এর কত বছর পর একদিন শীতের দুপুরে সবুজ মলাটের বই খুলে আমার সামনে ভেসে উঠবে আশ্চর্য কিছু পংক্তি :

"থুরথুরে অন্ধ পেঁচা অশ্বত্থের ডালে ব'সে এসে,
চোখ পাল্টায়ে কয় : বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে?"

জীবনের যত গভীর দ্যোতনাই বয়ে আনুক এই পংক্তি, সমালোচকেরা যে ব্যাখ্যাই দিক, পড়তে পড়তে প্রতিবারই কী আমার মনে পড়ে যায় নি  সেই আশ্চর্য সন্ধেটার কথা; সেই অদ্ভুত হুম হুম ডাক, আর আকাশে সাদা পাখা মেলে উড়ে যাওয়া সানন্দ পেঁচাটিকে!


হ্যাঁ, যা বলছিলাম, প্রত্যেকটা গল্পের মধ্যে সত্যিই একটা রেলপথ শুয়ে থাকে। সোজা সমান্তরাল নয়, কিছুটা আঁকাবাঁকা একটা রেলপথ। যা ক্রমেই শান্ত ঘুমন্ত নির্জন পাড়াগাঁ থেকে প্রিয়মুখগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে   যেতে চায়। ঝমঝম ঝমঝম চাকার শব্দে গতির আনন্দে ছিন্ন করে দিতে চায় সরল নিস্তরঙ্গ শিশুকাল, ভাঙা ডানা চড়ুইয়ের গল্প, বিকেলের মটরশুঁটি ক্ষেতে চড়ুইভাতি।  বাবুনদা'রা চলে যায় শহরের বড় ইস্কুলে পড়বে বলে। তারপর... হারিয়ে যায় জনসমুদ্রে। ওদের বাড়ির পাশের কুলগাছের নীচে তারপর কতদিন অবহেলায় পড়ে থাকে সেইসব রঙিন মারমেডের আঁশ আর রূপকথাগুলো।  জানিনা,  রাত্তিরে তাদের গা থেকে আজও আলো বেরোয় কী না...

5 comments:

  1. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  2. আহা! এত সুন্দর চিত্রকল্প। যার মধ্যে কোনও কল্পনা নেই। আছে আমার চোখের সামনে ঘটে যাওয়া কিছু অতি বাস্তব চিত্র যেন চোখের সামনে দৃশ্য হয়ে উড়ে বেড়ালো সারাক্ষণ।
    আমি শুধুমাত্র চিত্রে আটকে থাকতে চাইনা, কবিও না। ভাবনার দ্যোতনাময়তা স্যালুট জানাই। ব্যক্তিগত রূপকথায় আবিষ্ট হলাম

    ReplyDelete
  3. পড়তে পড়তে মগ্ন হলাম। কবিতা আর গল্প মিলে মিশে গেছে। চিত্ররূপময়।

    ReplyDelete
  4. এক আশ্চর্য মাদকতা ভর করে থাকল, থাকবেই।

    ReplyDelete

এক ঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে