Monday, December 17, 2018

প্রগতি বৈরাগী - ব‍্যক্তিগত রূপকথারা…



(১)মা,তোমাকে

মাঝরাতে কাঁটাতার পেরিয়ে এসেছিলো বছর উনিশের রোগা মেয়েটা, মিলিটারি কালি মাখা গর্ভিনী একটা দেশ, ভাঙা প্রেম, টুকরো খোয়াব আর অস্থির একাত্তর পেছনে ফেলে। টিনের বাক্সে ছিল দাঙ্গার আগুনে একরাতে সর্বস্বান্ত বাবার বোবা অসহায়তা,মায়ের ভেজা আঁচলে লুকোনো ভীতু চাউনি,ভাইবোনেদের অবুঝ ক্ষিদে আর ভাঙলেও না মচকানো শিরদাড়া ভরা জেদ।
তারপর এঘাটা,ওঘাটা,কুমির কামটের হা এড়িয়ে দিশেহারা ভাসতে ভাসতে মেয়ে বোঝে দেশ হারালেও,পায়ের তলার মাটি হারানো চলবেনা। চেনা মুখ অচেনা হয়, আত্মীয়জন আবছায়া। মেয়ে দাঁতে দাঁত চেপে,নখে মাটি আঁকড়ে লড়াই করে। পায়ের নীচের বসুমতী,মাথার উপরের সুয্যিঠাকুর আর “একলা চলো” বোলে রবীন্দ্রনাথ তাকে সঙ্গ দেন। ছোট্ট একটা চাকরি পায় মেয়ে, সাধে আর আলহাদে, ঘামে আর ভালবাসায় ছেনে একটুকরো ঘর বাঁধে।পুরোনো প্রেম ফিরে আসে সিঁদুর রঙ হয়ে। কিন্তু জীবন তো আর রূপকথা নয়, কিছু স্বপ্ন সত্যি হয় আর বেশিরভাগটাই অলীক সিলাইবুনাই। মেয়ে ঠিকভুল যাপন করে, তার বয়স বাড়ে, চোখের কোনে আলতো ভাঁজ, রগ ঘেষে রুপোলি ঝলক, কিন্ত মেয়ে লড়াই ছাড়েনা।
মা,...আমার কিছুতেই হার না মানা মা, আজ চারপাশটা যখন খুব দ্রুত বুড়ো আর ধূসর হয়ে যাচ্ছে, তোমার পয়ষট্টি বছরের চোখের ভাঁজে আজও ঝলসায় সেই উনিশের জেদ। আমার সব কবিতা, সব গল্পের নায়িকা তুমি। আমার নায়িকা, সে তোমার মতই, ঠিক যেন এক যোদ্ধা রাজকুমারী, যে রাঁধে, চুল বাঁধে, অফিস যায়, খরচা বাঁচাতে নিজে ঘুঁটে দেয় আর সন্ধেবেলা তুলসীতলায় প্রদীপ দেখিয়ে মেয়েকে গোর্কির “মা”-এর গল্প শোনায়, কখনো “কচদেবযানী” আবৃত্তি করে।
আজ আমি তো্মার থেকে হাজার মাইল দূ্রের শহরে। আমার বয়সও প্রায় তিরিশ ছুঁইছুঁই, কিন্তু তোমার “আমি তো আছি”-এর নরম ওম আজও আমায় আদরে মুড়ে দেয়। আমি জানি মা, তুমি সবসময় থাকবে না, শীতের দুপুরের রোদও তো একসময় আবছা হয়। কিন্তু যাবার আগে,আমায় তোমার ভেতরের ওই রোদটা দিয়ে যেও মা আর তোমার ওই হাজার ঝড়ঝাপটেও না নুয়ে পড়া শিরদাড়াটা।

(২)”সেসবই অলীক পরনকথা”

ছোটবেলায় ঘুম থেকে উঠেই সে লেপের মধ্যে একটা গুহা বানিয়ে ফেলতো, মুখটা শুধু বের করে দেখে নেওয়া, মা এতক্ষণে অফিস, দিদি স্কুলে, বাপী কোথায় কে জানে! বাইরে চড়াই শালিকের কিচিরকিচ, রান্নাঘরে দিদিমাসী পাশের বাড়ির বেড়ালটাকে বকাবকি করে মাছ কাটতে বসেছে। এসময় দিদিমাসীর হাতের আঙুল উপেন্দ্রকিশোরের  মেছোভূতের মতো ঠাণ্ডা থাকে, ভিজে ন‍্যাকড়ার মতো  আর আঁশ আঁশ গন্ধ। সাড়া পেয়ে কোলে নিতে আসার আগেই সে লাফ দিয়ে খাট থেকে নেমে পড়ে,
মোজা আর উলিকটের পাজামা পরে বাইরে এসে দাঁড়ায়।
বারান্দা ভাসিয়ে দিচ্ছে কমলালেবুর কোয়া ফেটে যাওয়া রঙের রোদ্দুর।
দিদিমাসী গরমজল আর তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছিয়ে দেয়, হাতে ধরিয়ে দেয় দুধের গ্লাস আর বানরুটি। অর্ধেক খেয়ে গ্লাস সরিয়ে রাখে সে, রুটি থেকে খুঁটে খুঁটে তোলে লাল সবুজ কিশমিশের টুকরো। রুটির লোভে উড়ে আসা ঘাড়কাত কাকেদের জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি দ্রিঘাংচু? তুমি? তুমি?”।
তারপর এদিকওদিক দেখে গ্রীলের দরজা খোলা। এত সকালে বাগানের মাঝখানে কুয়াশা ঢিবি হয়ে থাকে, তার সোয়েটারের গলা দিয়ে শীত ঢুকে পড়ছে। চকচকে লেবুপাতায় দানা দানা শিশির, যেন সোনার গাছে হীরের পাতা আর মুক্তোর ফল।
সে রুটির টুকরো ফেলতে ফেলতে এগোয়, এই জঙ্গলেই কোথাও আছে ডাইনি বাবা ইয়াগার পিঠে আর চকোলেটের বাড়ি। কাঠঠোকরা গাছ খুঁড়ছে 'কটোরকটোর’ করে, শুকনো পাতায় এলোমেলো, ভাঙাচোরা শব্দ, এইমাত্র তার মাথা ছুঁয়ে উড়ে গেল একটা সাদা ছোট্ট পাখি, জঙ্গলের ভিতর থেকে আওয়াজ আসে, 'উঁউঁ’, বুড়োমানুষের গানের মতো, সে নিঃশ্বাস চেপে একটু একটু এগোয়...

‘উঁ উঁ উঁ উঁ” পাম্পের একটানা আওয়াজে ঘুম ছিঁড়ে যায়, দূরে কোথাও মাইকে শিবস্তোত্র বাজছে। নীচের তলায় বাচ্চা মেয়েদুটি আজ আবার কিছু নিয়ে গলা তুলে ঝগড়া করছে। তার দরজা জানালা আঁটসাঁট ঘরে সকালের আলো ঢোকেনা, টিউবের ফ‍্যাটফেটে সাদায় জমাট বেঁধে থাকে রুমহিটারে সেঁকা গতরাতের বোঁদা বাতাস। আধবোজা চোখে মোবাইলে সময় দেখে তাড়াতাড়ি খাট থেকে নামতে যায়, চটি খুঁজে পায়না, ঠাণ্ডা মেঝে ‘ছ‍্যাৎ’ করে ওঠে পায়ের পাতায়, কুঁকড়ে যাওয়া আঙুলে।

(৩)মিহিন ফুলকথা

আমাদের ঘরবাড়িরা হাত ধরাধরি করে লালিত হোক আপনকথায়,...তার গেটের মাথায় ঝামরে পড়েছে বোগনভিলিয়া, পাঁচিল ঘেঁষে সমত্থ ছাতিম,জারুল, ভাঙা টাইলস বসানো পথের দুপাশে পুরু মসের বিছানা আর জানালা বেয়ে জড়িয়ে আছে কুমড়ো ফুল আর আলোকলতা ... থাক, পুকুরপাড়ে পা ছড়িয়ে বসে আছি। পা ঘিরে নতুন বউয়ের মত হলুদ শাড়ির লাল পাড়। বৃষ্টি আসব আসব করছে। সে খিড়কির দরজার সামনে থেকে ডাকছে। আর আমি ভাবছি, এমন দিনে কেউ ঘরে যায়?

...ঘর নেই। পুকুরঘাটের পুরোনো সিঁড়ি আছে, পাশের দিকে ভাঙা, শ্যাওলা ধরা।

পুকুরপাড়ের বকুল গাছটা বুড়ো হয়েছে, তবু জোলো হাওয়ায় দু-একটি ফুল ঝরে পড়লো মাথায়, হলুদ খড়কে ডুরের আঁচলে...হাতের মুঠোয় আলতো তুলে রাখছি তাদের... পুকুরের জলে বৃষ্টি ফোঁটা মিশে যাচ্ছে শান্ত, ঘাড় না ফিরিয়েই মোরাম বিছানো ঘাটের রাস্তায় শুনতে পাচ্ছি তার পায়ের আওয়াজ, পাশে এসে বসলে ফুলগুলো রেখে দেবো ওর পকেটে, আর রাতে দুইবালিশের মাঝে…


(৪)কনফেশন

আমার ডিস্লেক্সিয়া ফিরে আসছে আজকাল। একটা সাইকেল সেন্ট্রিফিউগাল ফোর্সে ঘুরতে থাকে মাথার ভিতরে, অথচ দুই ভুরুর মাঝে এসে বারবার ছিটকে পড়তে চায় সাইডলাইনের দড়ি ছিঁড়ে। আমি ছুটছি হাঁচোড়পাচোড়, তার শার্টের পিঠ আর আমার মুঠোর গ‍্যাপ বাড়তে বাড়তে অনন্ত হয়ে যাচ্ছে। আমি কি গতিতত্ত্ব ভুলে গেছি! হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড় বদলে যায় দূরপাল্লার হাঁটায়, পিঠ ফুঁড়ে পড়ে ফেলতে চাই বুকপকেটে রাখা বেগুনি চিঠি, যার শেষটুকু অগুন্তি এক্সো এক্সো-এর পর ভেঙেচুূরে যাচ্ছে “আই অ‍্যাম…, আই অ‍্যাম…, আই অ‍্যাম…”।

শব্দগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে শান্ত খোয়াবাঁধানো কলপাড় থেকে মডিউলার মিষ্ট্রিতে। পাজলবোর্ডে বসাতে যাচ্ছি, কেউ হয়ে যাচ্ছে হলুদ প্রজাপতি, কেউ লাল চোখের মত দাগওয়ালা ধূসর কাঁকড়াবিছে। আমাকে কেউ ছেড়ে যাচ্ছে, কাউকে আমি ধরে রাখতে ভয় পাচ্ছি। যে-কটা অক্ষর থালাবাটি ঘিরে খেতে বসেছিল একসাথে, এঁটোহাত ধোয়ার আগেই তারা পৃথগন্ন হয়ে চড়ে বসেছে ব‍্যক্তিগত মোটরগাড়িতে। আমার হাত শুকিয়ে খটখটে, গাড়ির মার্স রেড বনেট চোখ ঢেকে দিচ্ছে উচ্ছেদ নোটিশের মত। নাম্বার প্লেট জানে, সব ঠিকানা মনে রাখতে নেই। ফাইন দেওয়ার বদলে, অক্ষরগুলো সাজিয়ে ফেলছি নতুন ফর্ম‍্যাটে।

(৫) ফ‍্যান্টাসি

তুমি আমারে জোরেসোরে 'রেলেন্টলেস' কইয়া ফিরত গিলা।
আর এই যে আমার মাথার ভিত্তরে, অষ্টপ্রহর, দিনরাইত হাজারখান চরিত্র খেইলা বেড়াইতেসে, আপন আপন কাহানির সুতা বুনতাসে, হ্যার আমি কী করি এহন?
কেউ সিমোন দ্য বোভোয়ার 'দ্য সেকন্ড সেক্স'-এর লাহান আর একখান খতরনাক বয়ান লিখ্যা ফ্যালতে চায়, একজন কোকো সেনেলের থিক্যাও খোবসুরত ম্যাজিক তইয়ার করতে চায় রেশম আর শিফন মিশাইয়া, কেউ ফ্রিডার লাহান, ওহ ফ্রিডা, তারে যে কত্তো ভালোবাসি, মায়ের পেটের বুনের লাহান, আমরা কবে যেন একই প্ল্যাসেন্টায় মাতৃজলে ভাসছিলাম, ঠোঁটের লগে ঠোঁট লাগাইয়া বার্তা দিছিলাম আজন্ম ভালোবাসার, কবে যেন! ইচ্ছা করে তাইর লাহান ক্যানভাসের পর ক্যানভাস ভরাইয়া ফ্যালতে তিলস্মি পেইন্টিং-এ, মিশাইয়া দিতে শরীর থিক্যা বইয়া যাওয়া খুনের দাগ।
আমার মায়ের লাহান ফিনিক্স হইতে ইচ্ছা করে, ইচ্ছা করে দাঙ্গার ছাই আর ছিড়া বর্ডার পার হইয়া আইসা একখান মামুলি লেকিন জাদুকরী গল্প লিখতে, তুমার মায়ের লাহান বুকের ভিতর গনগন্যা আগুন ধইর‍্যা রাইখ্যা, উনানের পাড়ে একখান শান্ত আর স্বাদের ইলশাভাপা রাইনবার বইতেও মন চায়।
আর সবথিক্যা তুমুল ইচ্ছা করে, এই আষ্টেপৃষ্ঠে নগর লিখা খোলস ফাইড়্যা ফেইলা একখান নুতান, চিকন শ্যামল দেহ পাইতে, আর গেরুয়া কাঠায় গাছকোমর দিয়া, একতারা আর খঞ্জনী হাতে কুনু নাইদিগরে অ্যাক্কেরে মিলাইয়া যাইতে...
আমারে তুমি 'বাইপোলার' বিধান দিওনা, হ্যাতে আমার চরিত্র খাটো করা হইয়া যায়। দোহাই তুমার, পাইরলে আর কল্পনায় কুলাইলে আমারে তুমি 'থাউস্যান্ডস- পোলার' কইয়ো,... আমি তাইতে নাখুশ হইতাম না।

No comments:

Post a Comment

এক ঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে