মিছিল ফেরত লোকটি
(১)
প্যারামাউন্টের উল্টো দিকে গেটের পাশে সহদেবেদার চায়ের দোকান। বছর চল্লিশের লোকটি আজ প্রায় সাত আট বছর ধরে এখানে দোকানদারি করছে। সেই সকালে বেলা চলে আসে, গরম জল বসায়, ব্যাগ থেকে বিস্কুটগুলো নামায় আর তারপর সেই রাত দশটা পর্যন্ত দোকান খোলা রাখে। দশটা নাগাত সব কিছু গুটিয়ে তবে সে রওনা দেয়। বাদুড় বাগানে তার বাড়ি, হাঁটা পথ। প্রায় রোজই সে হেঁটে বাড়ি ফেরে। সোম থেকে শনি তার রোজকার কাজ। শুধু রোববার সে চায়ের দোকানে আসেনা। তবে তার চায়ের ঠেকে লোক খারাপ হয় না। আমরা অবশ্য মাঝে মাঝে আসি, তবে যখনি আসি তখন লোক ভালোই থাকে দেখি। কলেজের ছাত্র থেকে শুরু করে ঠেলা গাড়ি ওয়ালা সবাই তার খদ্দের। "সহদেব কই হে চা বসাও”, "দুটো বিড়ি নিলাম, খাতায় লিখে রেখ”, ...... চেনা কথাগুলো খদ্দেরের মত দোকানের আশে পাশে ঘুরে বেড়ায়।
আমি আর সৌরি সহদেবেদার চায়ের দোকানে এসে বসলাম। সৌরি ভিতরে মুখ বাড়িয়ে বলল, "সহদেবেদা দু কাপ দুধ চা দিও। ”
"দিই বসো।”
"দুটো ফ্লেক নিলাম,” বলে সৌরি খোলা সিগারেটের প্যাকেটের থেকে দুটো সিগারেট নিয়ে একটা আমাকে দিল। তারপর আগুন জ্বালিয়ে বলল "নে ধর।" সিগারেটটা টেনে আরামে আমার দুচোখ বুঝে এল। হাঁটতে হাঁটতে আমার পায়ের অবস্থা খুব খারাপ। একটু স্বগতোক্তি করে বললাম, "এ ভাবে কি পোষায়, সেই শালা সকাল থেকে বেড়িয়েছি, শুধু এ দোকান আর ও দোকান করে যাচ্ছি।”
"উফ, কি চাপ, এরকম একটা বিচ্ছিরি কাজ না, মাইরি! এমন একটা লোককে খুঁজতে দিয়েছে। সে শালা কোথায় থাকে? কি করে? কিছুই জানা নেই। ”
সিগারেট টানতে টানতে এদিকটা তাকিয়ে দেখি পুকুরের কাছে লোক জমতে শুরু হয়েছে। কেমন যেন একটা ব্যাস্ততা।
"কি ব্যাপার বলতো সৌরি, মিছিল টিছিল আছে নাকি আজ? সহদেবেদা তুমি কিছু জান?”
সহদেবেদা আমাদের দিকে দু গ্লাস চা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, "না বাপু , কিছু তো সেরকম শুনিনি, হতেও পারে। আবার না হতেও পারে। মিটিং মিছিল তো সব সময় লেগেই আছে ।”
"কোথায় লেগে আছে হে সহদেব, মানুষের সব রক্ত জল হয়ে গেছে। নয়তো চিনির পরিমাণ খুব বেড়ে গেছে, ” পাশ থেকে কথাটা আসতে আমরা দুজনেই ঘুরে তাকালাম। দেখলাম একজন মধ্য বস্কীয় রোগা পাতলা লোক, মুখ ভর্তি কাচা পাকা দাড়ি দোকানের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
"দাও, দাও, চা দাও, একটু তাড়াতাড়ি দাও, আজকে মিছিল আছে, আমায় যেতে হবে। ”
ভদ্রলোকের কথাবার্তা আমাদের মনে কৌতূহল জাগিয়ে তুলল। সৌরি আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, "কিসের মিছিল? কোন পার্টি করছে? ”
একটা বিস্কুট বের করে লোকটি বলল, "পার্টির ডাকা মিছিল নয়। কি যেন বলে না "এলজবিকিউ" (কথাটা এলজবিটিকিউ ) তাদের অধিকার নিয়ে মিছিল। কাল খবর পেয়েছি, বিকেল পাঁচটায় মিছিল শুরু হবে। ”
ভিতরে সহদেবদা আবার গরম জল বসিয়ে চায়ের সরঞ্জাম শুরু করে দিয়ে বলল, "বুঝতে পারলাম না, কারা? "
"আরে, ওই যে সমকামী নারী পুরুষ, তারা কি একটা পিটিশন দিচ্ছে, সেই নিয়ে মিছিল। এখান থেকে শুরু করে থিয়েটার রোড পর্যন্ত যাবে। ”
সহদেবদা গ্লাস ধুতে ধুতে বলল, "তা তুমি এই মিছিলে গিয়ে কি করবে ? ”
"সেকি যাব না কেন? মিছিলে হেঁটে দেখেছ কখন। যখন সবাই স্লোগান দেয়। সে এক ভারি অদ্ভুত ব্যাপার, আর তাছাড়া আমার নিজের অধিকার রক্ষার করার হলে বুঝি শুধু মিছিলে যেতে হয় ? ”
আমি সৌরির দিকে তাকিয়ে দেখি সে টান টান হয়ে বসেছে। ও নিশ্চয়ই কিছু একটার গন্ধ পেয়েছে, কোনও একটা গল্পের সন্ধান পেয়ে ওর সাংবাদিক সত্ত্বা ধনুকের মত সোজা হয়ে উঠেছে। ইত্যমধ্যে সহদেবদা লোকটির জন্য চা নিয়ে এসে গেছে। সৌরি সে ফাঁকে আরেক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে, ভদ্রলোকেরে দিকে ফিরে জিজগেশ করল, "আপনার নাম কি দাদা? ”
"কেন বলুন তো?”
"না এমনি জিজ্ঞেস করছিলাম, আমার নাম সৌরি সেন, একটি কাগজের অফিসে কাজ করি।”
"আমার নাম জগন্ময়, এখানে সবাই জগু বা জগা বলে ডাকে।”
"আপনি কোথায় কাজ করেন?”
"কিছুই করিনা, মিছিলে হেঁটে বেড়াই।” বলে লোকটা আধ খাওয়া বিড়িটা রাস্তার এক পাশে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
সৌরি এই উত্তরে মোটামুটি দমে গেল। লোকটা ফাজলামি মারছে নাতো। মালটাকেতো আগে কখন দেখিনি, সহদেবদার দোকানে আমরা বেশ কদিন আসছি, কলেজ স্কোয়ার চত্বরে। পাবলিকটা গেলে সহদেবদার থেকে লোকটার ব্যাপারে জানতে হবে। আমি ঠিক করেছিলাম কথা বলব না, কিন্তু লোভ সামলাতে না পেরে বললাম,
"কিন্তু এই মিছিলে, কত সাধারণ মানুষের অসুবিধা, ট্রাফিক জ্যাম, কত লোক ঘর্মাক্ত অবস্তায় আটকে আছে, বাড়ি যেতে পারছে না, কাজে যেতে পারছে না। ”
"সাধারণ মানুষ, তাই না, জানেন মিছিলে যারা যায় তারা প্রত্যেকেই অসাধারণ মানুষ। কেন যায় বলুনতো? কি দায় আছে তাদের যে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবে। কিছুদিন আগে যে 'কলেজের ছেলেরা দক্ষিণ কলকাতায় এত বড় আন্দোলন করল; এই যে এত ছাত্র ছাত্রী রাস্তায় নামল, কত মিছিল করল, কত লোকের কত অসুবিধা করল আর ফলে কি হল ? শুধু কত সভ্য সাধারণ লোক কত কুৎসা করল, গাঞ্জা খোর, পাতা খোর বলে খিস্তি করল। বলুনতো ওরা কি আগে কেউ মিছিল করেছিল? নাকি মিছিল করে সবাই পার্টির টিকিট পেয়ে গেল। জানেন আমিও কিন্তু ওদের সাথে হেঁটেছিলাম। আপনি কখন মিছিলে হেঁটে দেখেছেন, কি রকম একটা ঘোর লাগার মত অবস্থা হয়। চারদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ, তাদের ঘাম আপনার শরীর ছুঁচ্ছে। তাদের আওয়াজ আপনার কানের পর্দা ছিঁড়ে দিচ্ছে। কি যেন বলে না, শব্দ ব্রহ্ম! সে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ। সে আপনি বুঝবেন না । ”
সৌরি আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠল, "আমার তো মনে হয় কিছুটা হুজুগ, মাস হিস্টিরিয়া সৃষ্টি করা। খুব বিপজ্জনক ব্যাপার মশাই। একবার ভাবাবেগ তৈরি হলে যুক্তি, আলোচনার ধার ধারবে না, শুধুই আবেগের বশে চলবে। এবং আমরা এটা তো আমরা সবাই জানি যে একবার মানুষকে আবেগতাড়িত করে দিলে, সাঙ্গাতিক ভালো কিছু হতে পারে বা সাঙ্ঘাতিক খারাপ কিছু । তাছাড়া আরেকটা ব্যাপারও আছে যে প্রত্যেকটা মিছিলের পেছনে কিছু না কিছু একটা রাজনৈতিক অভিসন্ধি থাকে।”
"রাজনীতি তো থাকবে মশাই, রাজনীতি ছাড়া কোনও শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় নাকি। আপনার কোনও জানা বা শেখা রাজনীতি আর ক্ষমতার বাইরে নয়। আর মাস হিস্টিরিয়ার কথা বলছেন, আপনি ভাবুন তো যে মিছিল তৎকালীন যুগে নবদ্বীপের ভগবান শ্রী চৈতন্য বার করেছিল, একবার ভাবুন, আহা। সে ভাবাবেগের কি কোনও তুলনা হয়? ”
"সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু তা বলে কোনও অরাজনৈতিক শিক্ষা থাকবে না? সেটা কি করে সম্ভব? ”
"আরে মশাই, যে কোনো শিক্ষা আপনি নিন না কেন, যখনই কোনও মানুষের মুখ থেকে বেরচ্ছে, তখন সে কথা বা সেই শিক্ষা সেই মানুষটির রাজনৈতিক অবস্থানের উপর নির্ভর করে। যাই হোক, আমি এই সব নিয়ে ভাটাচ্চছি বা কেন? কই সহদেব পয়সাটা নাও,” বলে ভদ্রলোক চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে পড়ল।
সহদেবদা পয়সা নিয়ে দোকানের ভিতর গিয়ে বলল, "আজ জমলে হয়, আকাশের অবস্থা দেখেছ। ঢালবে মনে হচ্ছে।” লোকটি ততক্ষণে হাঁটা দিয়েছে। সিগনেট প্রেসের দোকানের সামনে গিয়ে কারুর সাথে কথা বলে আবার পুকুরের ওপারের দিকে চলে গেল।
সৌরি এবার নড়েচড়ে জানতে চাইল, "সহদেবদা, কে গো এই ভদ্রলোক? আগে কখন তোমার দোকানে দেখিনি। ” সহদেব দা হাই তুলে বলল, "নাম তো বললই, এদিকে কোথাও থাকে, ভ্যাগাবনড টাইপের। কিছুই বিশেষ করেনা। শুধু মিটিং, মিছিল করে বেড়ায়। কোনও ভাষণ থাকলে তাড়াতাড়ি এসে শুনতে বসে যায়। আর মিছিল হলে সব সময় একপায়ে রাজি। অনেকদিনের খদ্দের হে, তোমরা আর কদিন এলে। ”
"চলে কি করে?”
"সে রকম একটা কোথায় চলে, কিছু পৈত্রিক টাকা পয়সা আছে হয়তো, তাই দিয়ে চলে যায়। মাঝে মাঝে দেখেছি পোস্টার লাগাতে, বা প্যাম্ফলেট বিলি করতে। ওইরকম খুছখাছ কিছু করে হয়তো। মজার ব্যাপার হল এই যে, দিন নেই, রাত নেই, কোথাও কোন মিটিং মিছিল হচ্ছে খবর পেয়ে যায় আর ঠিক চলে যাবে সেখানে। কোলকাতার যেখানেই তা হোক।”
"ইন্টারেস্টিং চরিত্র, একটা মানুষ মিটিং ,মিছিলের প্রতি এত প্যাশনেট হতে পারে ভাবতে পাড়া যায় না, অদ্ভুত ব্যাপার তাই না।”-------------------------
- সেই দিনটা ছিল সোমবারের বিকেল, সময় এই ধরে নাও পাঁচটা থেকে ছটার মধ্যে। আকাশ যদিও বৃষ্টির কথা জানায়নি, তবু দেখে কেমন মনে হচ্ছিল যেন বৃষ্টি আসবে আসবে। কলেজ স্কোয়ারের মাথায় অনেকক্ষণ ধরে একটি কালো মেঘ ঘুরপাক খাচ্ছিল, তবে সম্পূর্ণ শক্তি সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি। নিচের মানুষগুলো ব্যাস্ত ছিল নিজেদের মত করে। পড়ন্ত বেলায় রোদের চিত্রনাট্যও ছিল শেষ হবার মুখে। হাওয়া দিচ্ছিল আর নিচের কিছু শুকনো ধুলো মিইয়ে যাওয়া শেষ রোদ বেয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টায় ব্যাস্ত ছিল। কলেজ পাড়া তখন সারা গায়ে অপুর গন্ধ মেখে এক বদলে যাওয়ার মধ্যে প্রাগৈতিহাসিক কলকাতাকে বাঁচিয়ে রাখছিল। দেখে মনে হচ্ছিল যে বৃষ্টি পড়লেও পড়তে পারে; অজস্র মানুষের অবিশ্রান্ত হাঁটার মধ্যে দিয়ে অবিরাম বৃষ্টির জল। আমাদের সাথে জগন্ময় বাবুর ওই একমাত্র দেখা। কিন্তু ওইটুকু দেখার ভিত্তিতে একটা কাহিনী সৃষ্টি হতে পারে সেটা আমরা হয়তো কেউ কোনদিন ভাবিনি।
(২)
এই ঘটনার পরে আরও তিন মাস কেটে গেছে। আমাদের কলেজ স্কোয়ারে নতুন করে যাবার প্রয়োজন হয়নি। আমরা সবাই কাজ করছি বা কাজ খুঁজে নিচ্ছি। আমি পত্রলেখাকে নিয়ে ভবানিপুরের নতুন বাড়ি একবার গিয়ে দেখে এলাম। সত্যি কথা বলতে সৌরির সাথে খুব একটা যে দেখা হচ্ছে তাও নয়। সে শালা খালি বিড়ি টানছে আর কাজ করে যাচ্ছে। দেখা হলে খালি হাত তুলে বলে, " পরে কথা হবে। ফোন করিস।" আর ফোনটা বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকে নাহলে সীমানার বাইরে থাকে। একদিন সুদেবের সাথে দেখা হলে তাকে সৌরির কথা জিজ্ঞেস করাতে সে বলল, "ভাই, সৌরির কথা আর জিজ্ঞেস করিস না। তার বিশাল হাব ভাব। সে যে কোথায় থাকে? কি যে করে? আমাদের মত চুনোপুঁটিরা কি করে বলবে বল? বরঞ্চ তুই এক কাজ কর, একদিন ক্লাবে যা দেখা হয়ে যেতে পারে, শুনেছি মালটা মাঝে মাঝে নাকি ওখানে যায়। ” সত্যিতো আমার মাথায় তো এই ক্লাবের কথা আসেনি। ওখানে গেলে ওকে সিউর পাওয়া যাবে। তাও ভাবলাম একটা মেসেজ করে দি যে শুক্রবার ক্লাবে যাচ্ছি, তুই এলে আয়। মেসেজ করাতে উত্তর পেলাম, "আসছি সাতটা নাগাত। "
ক্লাবে সৌরি ঠিক সময়ে পৌঁছে গেল। সাধারণত ও একটু লেট লতিফ পাবলিক কিনা! জিজ্ঞেস করলাম "বিয়ার খাবি তো”। "খেতে পারি" বলে সিগারেট নিয়ে বসে পড়ল। আমিই শুরু করলাম, "বল, তারপর তোর কি খবর?”
"খবর আর কি, তুই তো মোটামুটি জানিস অফিসের চাপ। তোর নতুন বাড়ি কতদূর? কবে ফিনিশ হচ্ছে।”
"এখন বাকি আছে, এই তো সেদিন লেখাকে নিয়ে গিয়ে দেখে এলাম।”
নানান টুকটাক গল্প চলতে লাগল। হটাৎ সৌরি বলল, "আচ্ছা তোর জগু বাবুকে মনে আছে। ”
"কে জগু বাবু?”
"আরে সেই যে সহদেবদার চায়ের দোকানে কয়েকমাস আগে দেখা হয়েছিল না। মিছিলে ফিছিলে শুধু ঘুরে বেড়ায়। কিরে মনে পড়ছে?”
"হ্যাঁ, হ্যাঁ এবার মনে পড়েছে। ওরকম হটাৎ করে নাম বললে কার মনে পড়ে? কত জগা, জগু বাজারে ঘুরছে।”
"হুম, জানিস ভদ্রলোক মারা গেছেন।”
"সেকিরে ! তুই কোত্থেকে জানলি? ”
"আরে কিছুদিন আগে কলেজ স্কোয়ারে গেছিলাম। যথারীতি সহদেবদার চায়ে দোকানে গিয়ে বসি। একথায়, দুকথায় সহদেবদা জানাল। ”
"কি করে মারা গেল জানিস? শরীর খারাপ ছিল নাকি?”
"ওদিকে, কোথাও মিছিল হচ্ছিল, হাটছিলেন ভালোই হটাৎ স্ট্রোক হয়। শুনলাম পাশে একটি ল্যাম্পপোষ্টের ধারে বসে পড়েন। কিছুক্ষণ ওই ভাবেই ছিলেন। তারপর লোকজন ধরে হাসপাতালে নিয়ে যায়, সেখানেই মারা যায়। লোকটা সবসময় মিছিল করত আর মিছিলেই মারা গেল, কি অদ্ভুত ব্যাপার না!.........” সৌরি বলতে লাগল।
আমার সৌরির কথা কানে ঢুকছিলনা। প্রথমদিনকার ভদ্রলোক বসে বসে চা খাচ্ছে সে ছবিটা বার বার চোখের সামনে ভেসে আসছিল। রাত্রে স্বপ্ন দেখলাম, আমি আর সৌরি মিছিলে হাঁটছি, পাশে জগু বাবু হাঁটছেন। কলেজ স্কোয়ার থেকে মিছিল শুরু হয়েছে, আমরা হাঁটছি প্রায় ১৫ মিনিট হয়ে গেল। পাশ থেকে জগু বাবু বলছে, "কি ভাই, কেমন লাগছে? রক্ত ফুটছে তো? ” আমরা হেসে জানতে চাইলাম, "জগুদা, এটা তোমার ক নম্বর মিছিল ?”
"সে কি ভাই লেখা, ঝোঁকা করে রেখেছি। হেঁটেই যাচ্ছি। ”
আরও জানতে চাইলাম, "যা খুঁজছ সেটা পেলে কি?”
"পেলাম বইকি। এত মানুষ, একি কম কথা হে। সবই বিচার পাওয়ার জন্য হাঁটছে। দুঃখ, কষ্ট নিয়ে হাঁটছে। বুঝতে পারছ না! হেঁটে চলো আর আওয়াজ দাও, আমাকে বলতে হবে না, নিজেরাই বুঝতে পারবে।”
আমাদের সামনে প্রচুর মানুষ, চারিদিকে পিলপিল করছে মাথা, দুচোখ যতদূর যায়, শুধু মানুষের মাথা আর মাথা। সবাই সামনে এগিয়ে চলছে , হটাৎ বোম পড়ার মত কিসের আওয়াজ পাওয়া গেল। নিমেষের মধ্যে মিছিল ছত্রখান হতে শুরু করল, চারিদিকে শুধু একটাই আওয়াজ "গুলি করছে, গুলি করছে”, আর আমরাও পাগলের মত ছুটতে আরম্ভ করলাম। হটাৎ দেখি জগুদা ল্যাম্পপোষ্টের পাশে ঘাড় গোঁজ করে বসে রয়েছে। সৌরি গিয়ে বলল, "জগুদা চলুন চলুন”। জগুদা কোনও উত্তর দিলনা। শুধু ঘাড় গোঁজ করে বসে রইল। স্বপ্নটা এই ভাবেই শেষ হয়ে গেল। উঠে দেখি গেঞ্জিটা অনেকটাই ভিজে গেছে ঘামে। রাত্রি তখন শেষ হয়নি। বারান্দায় বেড়িয়ে এসে দেখি চারিদিকে শুধু আকাশ আর আকাশ। আকাশ আর জলীয় বাষ্পর মধ্যবর্তী অঞ্চলে কিছু গান্ধর্ব স্থানে বাস করে আসছি আমরা চিরটাকাল।
(৩)
আমার মোটেই যাওয়ার ইচ্ছা ছিলনা, কিন্তু সৌরির পীড়াপীড়িতে বাধ্য হয়ে রাজি হলাম (সত্যি যাওয়ার ইচ্ছা ছিলনা, ঘটনাটা বলছি বলে সৌরির দিকে আঙুল ঘুড়িয়ে দিচ্ছি না)। মৃত্যুর খবরটা জানার পর বেশ কদিন কেটে গেছে। একজন লোকের সাথে আমাদের দশ মিনিট দেখা, কথা। তার মৃত্যুর খবর আর আমাদের মনে কতটুকু দাগ কাটতে পারে। কিন্তু বাস্তবিক ভাবে দেখা যাচ্ছে যে শুধু আমার নয়, সৌরির অবচেতন মনে ঘটনাটা ভীষণ ভাবে দাগ কেটেছে। এবং আমার মতে এই দুজনের দাগ কাটার ধরনটা আলাদা। সৌরির মনে এই মিটিং মিছিল প্যাশনটা একটা রোম্যান্টিসিজম সৃষ্টি করেছে আর সেই সঙ্গে ও একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে। আমার কাছে আকর্ষণটা একটা মানুষের এই অদ্ভুত জীবনবোধ। আমি বললাম, "কি হবে গিয়ে? একটা লোক মারা গেছে তার জীবন নিয়ে খোঁচাখুঁচি করার কি আছে?”
"খোঁচাখুঁচি কোথায় করছিরে। শুধু তার বাড়িটা খুঁজে বার করব। বাড়ির লোকদের বলব আমাদের সাথে একদিন আলাপ হয়েছিল, তার মৃত্যুর খবরটা পেয়ে ভাবলাম একবার দেখা করে যাই। ”
"তাতে লাভ?”
"লাভ একটাই, আমার দৃঢ় বিশ্বাস লোকটি খুব পণ্ডিত লোক ছিল, একদম ছুপা রুস্তম টাইপের । শুধু একবার তার ঘরে যদি একবার যেতে পারি, আর আমরা ধারনা যদি সত্যি হয়; তাহলে আমি প্রচুর বই দেখতে পাব সেই ঘরে। এবং আমার ধারনা ভদ্রলোক প্রচুর পড়াশোনা করেছিলেন এককালে, এবং এখন মাথাটা বিগড়ে গেছে ।”
"তুই কিন্তু অযথা রোম্যান্টিসিজম সৃষ্টি করার চেষ্টা করছিস।”
"নারে, একবার চল, আমার কথা যদি না হয় তখন বলিস, আমার মন বলছে লোকটার বাড়িতে প্রচুর রাজনৈতিক লেখা থাকবে। না হলে তুই ভাব সাধারণ মানুষ নিজের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রেই শুধু মিছিলে যাবে। সব মিছিলে হাঁটবে কেন? তোর মনে নেই লোকটা বলছিল না কোন শিক্ষা রাজনীতি ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। এই ধরনের কথা যে সে লোক কিন্তু বলে না। তার রাজনৈতিক শিক্ষা বা পড়াশোনা আছে নিশ্চয়ই। আরও একটা কারণ আছে যাবার, তবে সেটা আমি তোকে সেদিনই বলব। চাপ নিস না, কিছু ঝামেলা হবে না ।”
"হুম, কিন্তু কোথায় পাবি তার ঠিকানা, একদিন একটা লোকের সাথে আলাপ দশ মিনিটের জন্য, তার ঠিকানা যোগাড় করবি কিভাবে? ”
"এটা তুই কি বললি! কেন সহদেবদা আছেনা, ওর থেকে ঠিক পেয়ে যাবো।”
আমরা সহদেবদার কাছে গিয়ে ঠিকানার কথা জানতে চাওয়াতে, সহদেবদা বেজায় অবাক হয়ে বলল, "তোমাদের কাজ কারবার আমি কিছু বুঝিনা। আমার কাছে ঠিকানা নেই, তবে যোগাড় করতে পারি। ওদের ওদিকার একটি ছেলে এদিকে আসে মাঝে মাঝে। জিজ্ঞেস করে দেখব। তোমরা আর কটা দিন পর এসো।”
"ঠিক আছে তাই হবে, তুমি কিন্তু যোগাড় করে রেখ। ”
"আচ্ছা দাঁড়াও, তোমাদের আসতে হবে না, আমার মোবাইল নাম্বারটা নিয়ে যাও। ঠিকানা পাবো কিনা ঠিক নেই শুধু শুধু এইজন্য আসতে হবেনা। চা খেতে এসো, সে আলাদা ব্যাপার। আমি জিজ্ঞেস করে রাখব। তোমরা এক সপ্তাহ পরে আমায় ফোন করো।”
আমরা সেদিন সহদেবদার ফোন নাম্বার নিয়ে চলে আসি। এবং সত্যি সত্যি এক সপ্তাহ পরে সহদেবদার কাছ থেকে লোকটির ঠিকানা পেয়েও যাই। এবং এও জানতে পারি সে ভদ্রলোকের বাড়িতে তার ভাইপো ছাড়া আর কেউ থাকেনা।
আমরা একটা রোববার টার্গেট করে বেড়িয়ে পড়ি। বাড়ি খুঁজতে আমাদের বিশেষ অসুবিধা হয়নি, অবশ্য হাঁটতে হয়েছিল কিছুটা। পুরানো দিনে উত্তর কোলকাতার বাড়ি। খড়খড়ি দেওয়া জানলা। বেল বাজাতে একটা এিশ- বত্রিশ বছরের একটি যুবক দরজা খুলে দেয়।
"কাকে চান?”
আমি কিছু বলার আগে, সৌরি এগিয়ে এসে বলল, "আপনি তো খোকন পাল, জগন্ময় বাবুর ভাইপো।”
"হ্যাঁ, আপনারা কাকাকে চেনেন।”
"আমাদের সাথে উনার আলাপ হয়েছিল। এই শোক সংবাদটা কিছুদিন আগে পাই। উনার সাথে তো দেখা হলনা, তাই ভাবলাম একবার উনার বাড়িতে গিয়ে দেখা করে আসি।”
"আপনারা কি পার্টির লোক?”
আমি বলতে যাচ্ছিলাম উনি কি পার্টি করতেন? সৌরি আমায় থামিয়ে য়ে বলল, "পার্টির লোকেরা এসছিল নাকি?”
"না না তারা কেন আসবে? সে কোন জন্মে পার্টির সাথে সম্পর্ক চুকে গেছে। আসুন আসুন ভিতরে আসুন।"
আমি সৌরির দিকে তাকিয়ে দেখি ওর মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। ওর মনে যে কি আছে ওই জানে। কিসের যে উত্তেজনা আমি বুঝতে পারছি না। মনে হয় ও কিছু খবর সংগ্রহ করেছে যেটা আমায় বলছে না। আমার তো পুরো ব্যাপারটা এতটা অবাস্তব লাগছে। আমরা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছি, হটাৎ বিদ্যুৎ চমকের মত আমার মাথায় ভাবনাটা আসে। কোন স্মৃতি ভ্রংশ হয়ে যাওয়া কোন রাজনৈতিক নেতা নয়ত? তাও কি সম্ভব? খাস কোলকাতার বুকে কেউ জানতে পারবে না। দাহ হয়ে গেল আর কেউ টের পেলনা। উত্তেজনায় কেঁপে উঠলাম। সৌরিকে কথাটা বলতে ও চোখ বড় বড় করে ঠোঁটে অঙুল রাখল।
"বসুন, চা খাবেন,” মনে হল অনেকটা দূর থেকে কথাটা এল।
"খেতে পারি, আচ্ছা এটা কি আপনার কাকার ঘর?”
"না, না কাকা পাশের ঘরে থাকতেন।"
আমি জানি সৌরির মনটা ওই ঘরের দিকে পরে আছে। এবার আমারও উত্তেজনা হচ্ছে বইকি। খোকন পাল চা নিয়ে এসে আমাদের মোক্ষম প্রশ্নটা করলেন।
"আচ্ছা, আপনাদের সাথে কাকার কোথায় আলাপ? আপনাদের কাছে কোন ধার করে যায়নি তো?”
প্রশ্নটা আমাদের মাটিতে ফিরিয়ে দিলে, দেখি সৌরি ধাক্কাটা সামলে নিয়ে , কি ভাবে পরিচয় হল তা নিয়ে একটা আষাঢ়ে গল্প ফেঁদে মোটামুটি কনভিন্স করিয়ে ফেলল। কিন্তু সৌরির রোম্যান্টিসিজম প্রাথমিক যে ধাক্কাটা খেল সেটা বেশ বড়। জানা গেল ভদ্রলোক নাকি বিভিন্ন জায়গার থেকে ধার করে রেখেছে, যদিও বেশি না। ব্যাপারটা ভাইপোর কাছে গোপন থাকাতে তার কাছে কাছে সেটা আরও বেশ অস্বস্তি জনক। কথাবার্তা শুনে মনে হল ছেলেটি অল্প বয়সে চাকরি করতে শুরু করে দেয় আর খাওয়া দাওয়ার খরচ মূলত সেই চালাত। এদিকে সৌরি কথা চালিয়ে যেতে লাগল। এবং যত চালাতে লাগল তত দমে যেতে লাগল। অদ্ভুত ভাবে আমার কিন্তু বেশ ভালো লাগতে শুরু করল। যেটুকু জানা গেল ভদ্রলোক কোনও ভাবেই উচ্চ শিক্ষিত নন। সামান্য গ্র্যাজুয়েট, তাও অনার্স নন। রাজনৈতিক পরিচয় বলতে যতটুকু যুবক বয়সে পার্টির হয়ে মাঝে মাঝে মিটিং এর সময় লোক যোগাড় করে দিত আর কখন সখন পোস্টার প্যামফ্লেট বিলি করত, যা আমাদের সহদেবদা আগেই বলেছিল। যেটা ভাইপোর কাছে আমাদের মতই
অবাক করার মত ঘটনা যে ভদ্রলোক দিন নেই, রাত নেই, সব সময় কোথায় কি মিছিল হচ্ছে খবর রাখত আর ঠিক চলে যেত। আমি জানি সৌরি আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে হিসেব মেলানোর, কিন্তু কিছুতেই হিসেব মিলিয়ে উঠতে পারছেনা। আমার আবার এই হিসেব না মেলার ব্যাপারটা বেশ ভালো লাগছে। আর এই ভালো লাগার ব্যাপারটা ক্রমশ একটা আনন্দের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তাও সৌরি শেষমেশ একটা চেষ্টা করে বলে ফেলল, "আচ্ছা উনার ঘরটা একবার কি দেখা যাবে?”
জগন্ময় পালের ঘরে যেতে একটি খাট, আলনা, দুটো ছবি আর দু চারটি বই ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না। বই গুলো দেখে একটু আশ্চর্য হলাম, সব কটাই কবিতার বই। জিজ্ঞেস করলাম, "উনি কি কবিতা ভালবাসতেন?”
"লেখার চেষ্টাও করেছিলেন, কিন্তু......”
এর পরে আমাদের আর কিছু জিজ্ঞাস্য ছিল না। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা বেড়িয়ে পড়ি। বাইরে আসার পর সৌরি একটাও কথা বলেনি। শেষমেশ বলল, "আমি এই অভিজ্ঞতার কথা লিখব ভেবেছিলাম।কিন্তু আমার অনুমান যখন মিলল না, তখন আমি আর লিখব না, এটা তুই চাইলে লিখতে পারিস। যদি লিখিস তবে সত্যিটা লিখিস, গল্পের খাতিরে অতিরঞ্জন করিসনা। জানিস তো "Truth is stranger than fiction”। "
"লিখব,তবে জানিনা সবার কাছে এটা লেখার মত কিছু ঘটনা কিনা। কিন্তু আমার কাছে তো বটেই।”
"আমার কাছেও।”
সৌরি অটো ধরে চলে যাবার পরে অনেকক্ষণ রাস্তার ধারে বেঞ্চিতে বসে ছিলাম। হয়তো কোন দূরের আলোকবর্ষের ঘটনা হটাৎ করে আমাদের কাছে চলে এসেছে। ল্যাম্পপোষ্টের পাশে কেউ বসে পড়েছে। দুপুরে রোদে ক্লান্ত হয়ে মাথায় জল ঢালছে। ভ্রুক্ষেপহীন শহরের কাছে এই সব হয়তো ক্রমশ দুরের জীবন হয়ে যাচ্ছে, আরও হবে, হতে চলেছে। দুটি অল্প বয়স্ক ছেলেমেয়ে পাশ দিয়ে বলতে বলতে চলে গেল, "কাল নাকি মিছিল আছে না, যাবি?” তাদের এই কথা শুনে কেউ যেন ধমকে উঠল "ভাই, এটা কি শুধু টুরিস্ট প্লেস? যাও, অবশ্যই যাও তবে শুধু বেড়াবার জায়গা ভেবে যেও না।"
তাদের এই কথা শুনে কেউ যেন ধমকে উঠল "ভাই, এটা কি শুধু টুরিস্ট প্লেস? যাও, অবশ্যই যাও তবে শুধু বেড়াবার জায়গা ভেবে যেও না।"
ReplyDelete:)
Deleteচমৎকার। একটা অত্যন্ত সঠিক বিষয়, ছোট গল্পের। কিছু টাইপো আছে। বয়স্ক টা বস্কীয় হয়ে গেছে। আর উনার না, ওঁর লিখলে ভাল হত। গদ্যটা তরতরে। জীবন থেকে উঠে আসছে।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ দিদি
Delete