Monday, December 17, 2018

দেবব্রত শ্যাম রায়- রূপকথার জন্ম ও মৃত্যু






এক


'
ছোট্ট গোল রুটি/ চলছি গুটিগুটি / গমের ধামা চেঁছে/ ময়দার টিন মুছে/ ময়ান দিয়ে ঠেসে / ঘি দিয়ে ভেজে/ জুড়োতে দিল যেই / পালিয়ে গেলাম সেই / বুড়ো পেল না / বুড়ি পেল না / খরগোশ পেল না / নেকড়ে পেল না / ভালুক পেল না / সেয়ানা শেয়ালতুইও পাবি না।'

একটা গোল রুটি। রুটিটা গড়গড়িয়ে চলেছে গল্পের বরফঢাকা উপত্যকা বেয়ে। 

বুড়োবুড়িভালুকখরগোসশেয়াল সকলেই খেতে চাইছে তাকে। কেউ পারছে না। আমরা যারা আশির দশকে কিশোর কিশোরী ছিলাম... যাদের একটু আধটু গল্পের বই পড়ার অভ্যেস ছিলতারা হয়তো সকলেই এই গল্পটা চিনি। 'রুশদেশের উপকথা'-র প্রথম গল্প। ননী ভৌমিক সোভিয়েতে গিয়েথেকেসে দেশের লোককথা সংগ্রহ করেপড়েঅনুবাদ করেলিখে ফেলেছিলেন এই অসামান্য বই। ঠাকুরমার ঝুলিবুড়ো আংলাপদিপিসির বর্মী বাক্স-এর মতো এই বইও বাংলা সাহিত্যের এক সেরা সম্পদ।

১৯৫৭ সালে প্রগতি প্রকাশনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে অনুবাদকের কাজ নিয়ে মস্কো চলে যাচ্ছেন ননী ভৌমিক। আর তার বছর পনেরো বাদেহুগলি শিল্পাঞ্চলেএকটি ছিন্নমূল পরিবারের অযত্নলালিত পঞ্চম সন্তানযিনি ঘটনাচক্রে আমার পিতৃদেবতাঁর একদা ব্রিটিশ কোম্পানিটা মালিকানা হস্তান্তরজনিত কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ আমার বাবা-মা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেনসদ্যআর তার কিছুদিনের মধ্যেই বাবার চাকরি নেই। কিন্তু রুটির গড়ানো তো বন্ধ হলে চলবে না। মা সরকারি প্রাথমিক স্কুলে সামান্য মাইনেয় শিক্ষকতা করছেনপাশাপাশি নিজের পিতৃহীন ছোট ছোট ভাইবোনের পড়াশুনোর দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। অন্যদিকে ছোট-বড় নানা কাজ খুঁজে খুঁজে করে চলেছেন বাবা। একমাত্র আর্থিক কারণে বিলম্বিত হয়ে চলেছে তাঁদের একমাত্র সন্তানের জন্ম। বেশিদিন অপেক্ষা না করে বড় রাস্তার পাশে একখণ্ড জমিতে সেকেন্ডহ্যান্ড লেদ মেশিন কিনে ব্যাবসা শুরু করে দিলেন বাবা। পুঁজি বলতে অতি সামান্য সঞ্চয় ও বছর দশেকের অভিজ্ঞতা। আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটল সেবছর। বিপুল জনসমর্থন পেয়ে সেবারই রাজ্যে প্রথমবার ক্ষমতায় এল বামফ্রন্ট। একটি শিশুরও জন্ম হল। 

কয়েক বছর পর সেই ছোটখাটো কারখানায় আরও ছোট আমি সবে ঘোরাফেরা করতে শুরু করেছি। বাবা আস্তে আস্তে আরও কয়েকটা মেশিন কিনে ফেলেছেনবলাই বাহুল্যসবক'টি সেকেন্ডহ্যাণ্ড। সেইসব মেশিনের ঘর্ঘর ধ্বনি ও মধ্যবর্তী নীরবতার মধ্যে কাটছে আমার স্কুলছুটির দুপুরগুলো। অ্যাসবেস্টসের নীচে জমে ওঠা উষ্ণ হাওয়ায় মবিল গ্রিস আর লোহার গুঁড়ো মিলেমিশে কেমন যেন অন্যরকম একটা গন্ধ। ক্লাসে বীজগণিতের অংক শিখতে তখনও ঢের দেরিকিন্তু ততদিনে আমি জেনে গেছি মিলিং মেশিন কী কাজ করেগ্রাইন্ডিং বা ওয়েল্ডিং কেন করতে হয়। একটি ধাতুখণ্ড কীভাবে এক যন্ত্র থেকে আরেক যন্ত্রে রূপ বদলাতে থাকে আর ধাতুপোড়া গরম বাবড়ির টুকরো এধারে ওধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। একপাশে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁ করে তাই দেখে যেতাম। 

এমনই এক নির্জন কর্মব্যস্ত দুপুরে কারখানায় বাবার টেবিলে প্রথমবার এসে পড়ল একখানি বুকপোস্ট। প্যাকেট খুলে পাওয়া গেল একটি ম্যাগাজিন। না, 'আনন্দমেলা'-র মতো আকারে ছোট নয়ঢাউসআদ্যন্ত চকচকে মসৃণ কাগজে ছাপারঙিন ছবিতে ভরা এক পত্রিকা৷ অনুবাদ করা নানা লেখাঅচেনা দেশের না-চেনা শহরের ছবিজীবনযাত্রামানুষের হাসিমুখলাল লাল ফুলোফুলো গালের বাচ্চাদের ছবি। তারপর থেকে প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বাবার তেলকালিমাখা টেবিলে ছপাত করে এসে পড়ত এই বুকপোস্ট। অপেক্ষায় থাকতাম। বুক পোস্টের কাগজ ছিঁড়ে মলাটে নাক ঠেকিয়ে গন্ধ নেওয়া ছিল আমার প্রথম কাজ৷ দ্রুত ছবিগুলো দেখে নিয়ে পত্রিকার শেষে চলে যেতাম। সেখানে তখন নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে ছোট ছোট লোককথাইয়াগা আর যাদুকরী ভাসিলিসার কাহিনীইভান নামের তেজী ছেলেটার দুরন্তপনার গল্প। আর হাতে আঁকা দারুণ দারুণ সব ছবি। তখন খেয়াল করিনিঅনেক পরে জেনেছিএই লেখাগুলোর অনেকগুলোই বেরিয়েছিল অরুণ সোমরেখা চট্টোপাধ্যায়এবং অবশ্যই ননী ভৌমিকের কলম থেকে। রাশিয়ান মেয়ে শ্বেতলানাকে বিয়ে করেন তখন মস্কোতেই পাকাপাকি সংসার পেতেছেন ননী। পাশাপাশিরুশ থেকে বাংলায় লিখে চলেছেন অনর্গল। তাঁর লেখায়ছবিতে-গল্পে আমার কিশোর চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠছে সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর পারের এক অজানা ও সর্বার্থে রূপকথার দেশ।  
দুই

আমাদের ছোটবেলার মফস্বলী সকালটা ভারি মনোরম ছিল। প্রতিদিন ঠিক সকাল ছ'টায় অদূরে চটকল থেকে ভেসে আসা লম্বা ভোঁ শুনে ঘুম ভাঙত৷ হুগলি নদীর তীরে ছোট-মাঝারি-বড় নানা শিল্প দিয়ে ঘেরা আমাদের শান্ত সবুজ মফস্বল। এমনই কোনও এক কারখানার রাতের দারোয়ান রামশরণ গোয়ালা রোজ সকালে নিজের হাতে দোয়ানো গরুর দুধ দিতে আসতেন আমাদের বাড়ি। ভোরবেলা উঠে হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসার খানিক পরে রিনিদিদিদের বাড়ি থেকে ভেসে আসত গলা সাধার আওয়াজ। শুধু রিনিদিদি নয়তখন বাড়ির মেয়েদের সকাল-সন্ধে হারমোনিয়াম নিয়ে রেওয়াজে বসার নিয়ম ছিল। লাল ফিতে দিয়ে দু’টো বিনুনি বেঁধে গান গাইতে বসেছে রিনিদিদিওদের বাড়ি গেলে দেখতে পেতাম। প্রথমে রবীন্দ্রসঙ্গীততারপর কোনওদিন নজরুলকখনও দ্বিজেন্দ্রলাল। কোনও কোনওদিন সকালে বাবার সঙ্গে বাজারে গেলে দেখতাম প্রায় গোটা রাস্তা জুড়ে যেন সাইকেলের মিছিলক্রিং ক্রিং কোরাস। হাতলে কাপড়ের ব্যাগতাতে টিফিন ক্যারিয়ার ঝুলিয়ে আশেপাশের কলকারখানাগুলিতে সকাল আটটার শিফটে যোগ দিতে যাচ্ছে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক-কর্মীদল। আবার তাঁদেরই আয়ের ওপর ভিত্তি করে বেঁচে আছে অনেক ছোটবড় দোকানদারসেলুন থেকে চা-ওলা। বস্তুতআশির দশকে আমাদের মফস্বলের অর্থনীতির একটা বড় অংশ এইসব কলকারখানাগুলির স্বাস্থ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল।

প্রতিবেশী যতীনকাকা জনস্টন পাম্পের ফিটার ছিলেন। পরে শুনেছিউনি অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। আমাদের বাড়িতে মাঝেমধ্যেই খবরের কাগজ পড়তে আসতেন। বাবার সঙ্গে বসে চা খেতেন। নেড়েচেড়ে দেখতেন ডাঁই করে রাখা পুরোনো 'সোভিয়েত দেশ'। আমাকে ওখানকার বড় বড় কারখানার ছবি দেখিয়ে বলতেনজানিসওই দেশে সবাই সাধ্যমত কাজ করে। সবার কাছে কাজ আছেকাজের পর মানুষ নির্ভাবনায় আনন্দে মাতে। ও দেশে বেকার নেইসবার জন্য খাবার আছেথাকার ঘর আছে। চুরিচামারি নেইঅসুখবিসুখ ছাড়া কারও কোনও দুঃখকষ্ট নেই। দরকারের বেশিরভাগ জিনিস সরকার থেকে দেওয়া হয়বাজার থেকে কিনতে হয় না। যতীনকাকা যা বলে যেতেনআমি বুঝতাম না অনেকটাইতবু শুনতামশুনতে ভালো লাগত। যতীনকাকা বলতেনএকদিন সারা পৃথিবীটা এইরকম হয়ে যাবে, কোনও শোষণ থাকবে না, দেখিস! দেখতামকথাগুলো বলার সময় চকচক করে উঠছে ওঁর চোখ।

এহেন শিল্পাঞ্চল-নির্ভর আমাদের মফস্বলে একটা বড় উৎসব ছিল বিশ্বকর্মা পুজো। আমাদের বাড়িতে অর্থাৎ বাবার কারখানায় বিশ্বকর্মা পুজো হত। বিশ্বকর্মায় স্কুল ছুটি থাকলেও একমাত্র আমি ছাড়া আর কোনও বন্ধুর বাড়িতেই এই পুজো হত নাএই ব্যাপারটা নিয়ে একটা প্রচ্ছন্ন গর্ব ছিল আমার। আগেরদিন স্কুল থেকে ফিরে মা আর কারখানার কাকুদের সাথে বাজারে যেতাম। বাবা যে এইসব প্রস্তুতির কাজে সবসময় থাকতে পারতেনতা নয়। সেপ্টেম্বর মাসটা জুড়ে পেমেন্ট আদায়ের জন্য বাবাকে ছোটাছুটি করতে হত। বিশ্বকর্মা পুজোর ঠিক আগের দিন বাবা সমস্ত কর্মচারীদের পুজোর বোনাস দেওয়ার চেষ্টা করতেন। পুজো শেষে দুপুরে সকলের জন্য গরম গরম মাংস ভাত। তখন মাংস মানে শুধুই খাসি। মনে আছেসেই সময় কোনও এক বছর বাবার সঙ্গে কেরুলিয়া বাজারে মাংস কিনতে গিয়ে খাসির মাংসের দর দেখেছিলামএক কিলোর দাম চৌত্রিশ টাকা।
সন্ধে নামলে বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়া যেত। মফস্বলের আনাচেকানাচেবি টি রোডের দু'ধার দিয়ে সারবাঁধা অজস্র ছোটবড় কারখানা। অন্যদিন পাশ দিয়ে যাবার সময় মনে হতএত উঁচু উঁচু পাঁচিলের ওধারে আছেটা কী! বছরের এই একটিমাত্র দিনে কারখানাগুলোর গেট সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হত। কারখানাগুলোর আভিজাত্য অনুযায়ী একেকটা পুজোর একেকরকম ঠাঁটবাট। কোনও কারখানার ঠিক মাঝখানে কেয়ারি করা ফুলের বাগানতাতে লাল নীল আলোর নৃত্যরতা ঝরনা। জনস্টন পাম্পে গেলেই যতীনকাকু আমাদের ধরে বসিয়ে পেট পুরে মিষ্টি খাইয়ে দিতেন। সারা কারখানা ঘুরিয়ে দেখাতেন। ভিতরে ঢুকে দেখতাম বড় বড় নাম-না-জানা মেশিনআকাশছোঁয়া ক্রেইনতীব্র ওয়াটের আলো। 'সোভিয়েত দেশ'-এ দেখা বিশাল বিশাল কলকারখানার ছবিগুলোর সঙ্গে মনে মনে মিলিয়ে নেবার চেষ্টা করতাম৷ আমাদের চোখের সামনে বিভিন্ন আকারের দৈতাকৃতি ইস্পাতের স্তুপ মাইল জুড়ে নিঃশব্দে শুয়ে থাকত।

বাড়ি ফিরে দেখতাম বাবার কয়েকজন বন্ধু এসেছেনযমুনা আংকলআনসারিকাকু। প্রতি বছরই আসেন৷ বন্ধুদের নিয়ে বাবা বসেছেন চিলেকোঠার ছোট্ট ঘরটায়। মা ওখানে যেতে বারণ করতেন। বলতেন- 'ওখানে বড়রা আছেতোমার যেতে হবে না। এখানে বোস।তাও লুকিয়ে চলে যেতাম। চিলেকোঠার ঘরের ভেজানো দরজাটা খুব সন্তর্পণে আলতো ফাঁক করলেই ভক করে বেরিয়ে আসত ঝাঁঝালো গন্ধ। এর মধ্যে একটা গন্ধ আমি চিনি। ক্যাপস্টান। বাবা খান। ঠিক একই সময় কারখানাতেও বড় লেদটার পেছনে জটলাঅজিতকাকুদের হাতে চা খাওয়ার স্টিলের গ্লাস। পোড়া বাবড়ির বদলে বাতাসে আমোদের গন্ধ।

পরেস্কুলজীবনের শেষের দিকে সবে বুর্জোয়া প্রলেতারিয়েত এই শব্দগুলোর সাথে পরিচিত হচ্ছি। একজন বাঙালির ছেলের ওই শব্দগুলি না শুনে উপায় নেই। ভোটের আগে মাইকে পার্টির লাগাতার প্রচার হত। খবরের কাগজএদিক ওদিক থেকে টুকটাক লেখা পড়েব্যাপারগুলো মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করতাম। তার মানে সোজা হিসেবেবাজাজ আংকেলআমার বাবা এরা সবাই পুঁজিপতি ছিলেনআর কারখানার কাকুরা শ্রমিক অর্থাৎ সর্বহারা। বলা আছেপুঁজিপতিরা তো শ্রমিকদের শোষণ করে নিজেদের মুনাফা বাড়ায়। তার মানে কি বাবাও কাকুদের শোষণ করতমাইনে কম দিতএকদিন স্কুলের বসে সময়মতো উঠতে না পারলেতপনকাকুকে সাইকেলে করে আমাকে স্কুলে পৌঁছে দিতে বলত বাবা। মা ভালো কিছু রাঁধলে কারখানার কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিত দিদার বাড়ি। এগুলোও কি শোষণ ছিলপাশাপাশি, এমন দিনও গেছে বাবা পেমেন্ট না পেলে কারখানায় মাইনে দেওয়ার জন্য মা’র বেতনে হাত পড়েছে। আমাদের কারখানা একবার বন্ধ হয়ে গেছিল। শুনেছিলাম তপনকাকু কাজে কী একটা বড় ভুল করায় বাবা মাথা গরম করে একটা বাজে খিস্তি দিয়েছিল। সেদিন থেকে সবাই মিলে কাজে আসা বন্ধ করে দেয়। স্ট্রাইক। শব্দটা জানতাম। বাবাকে আমার সামনে খারাপ কথা বলতে শুনিনি। তার মানে কি বাবা আড়ালে খিস্তি দেয়সেদিন ঠিক কী ঘটেছিলবাবাকে কোনওদিন জিজ্ঞেস করা হয়নি। আজ এতদিন পরে বৃদ্ধঅবসৃত বাবাকে ক্ষতি সামলাতে না পেরে বন্ধ করে দেওয়া কারখানাটার কথা মনে করানোরও কোনও মানে নেই। সেবার সাতদিন বন্ধ থাকার পরে কারখানাটা আবার খুলেছিলকিন্তু সম্ভবত সেদিনের ঘটনায় আমার রূপকথাময় শৈশব আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়ে যায়।

                       

তিন
১৯৯১ সালেক্রিসমাসের পরদিনসোভিয়েত ইউনিয়ন টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যায়। সোভিয়েত মানে শুধুই রুশদেশ ছিল নাআমরা খেয়াল করিনিএর সঙ্গে মিশে ছিল ইউক্রেনআজারবাইজানআর্মেনিয়া ইত্যাদি আরও চোদ্দটি জাতিসত্ত্বার অস্তিত্ব। প্রত্যেকে মাথা তোলে। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করত বিশ্বজোড়া যেসব অগুনতি মানুষতাঁদের পাঁজরে ভাঙচুরের শব্দ ওঠে৷ এমন তো হওয়ার কথা ছিল না! নাকি এমনই হওয়ার ছিলযতীনকাকাশুধু কি বাইরের চাপনাকি ভিতরেই গাঢ় হয়ে ঘনিয়ে এসেছিল সংকটযা দূর থেকে অনেকদিন পর্যন্ত বোঝা যায়নি। সোভিয়েত দেশ-এর সেইসব উজ্জ্বল পৃষ্ঠাহাসিভরা লাল লাল গালের ছেলেমেয়েদের মুখঅত আনন্দ আর খুশি সেগুলো তার মানে সত্যি সত্যিই অতটা সুন্দর ছিল নাভাঁওতা আর অবদমন মেশানো ছিল তার সাথেকিন্তু ওই যে স্বপ্নটাসারা পৃথিবী একদিন এইরকম সুন্দর হবেথাকা-খাওয়ার কষ্ট থাকবে না কোনওসবার জন্য কাজ থাকবেকাজের পরে গান থাকবেসাহিত্য থাকবেঐ স্বপ্নটাও কি স্রেফ আরেকটা রূপকথা-ই ছিল তার মানে?

আর যিনি বাঙালি ছেলেমেয়ের জন্য রূপকথার গল্প লিখতেন মস্কোয় বসেতাঁরই বা কী হল? তথ্য জানাচ্ছে, একানব্বইয়ের পরেও আরও পাঁচ বছর বেঁচেছিলেন ননী ভৌমিক। তখন তিনি এক স্বপ্নহীন কর্মহীন বৃদ্ধএকইসঙ্গে অর্থকষ্টে জীর্ণ ও পুত্রশোকে কাতর। আর স্বপ্ন না দেখলে কি আদৌ বেঁচে থাকা যায়! ১৯৯৬ খ্রীস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে মস্কো শহরেই এক পথদুর্ঘটনায় মারা যান ননী ভৌমিক। প্রতিবিপ্লব-উত্তর দেশে রূপকথা লেখার মানুষের প্রয়োজনই বা কী

প্রতিবিপ্লব শুরু হয়েছিল গঙ্গার পারেও। যতীনকাকার কারখানা তখন প্রায় বছর দুয়েক বন্ধ। শুধু তাঁরই নয়হুগলির দু'পারে একের পর এক কারখানায় তালা ঝুলে যাচ্ছিল। কারণ অনেকপ্রতিটি ভারী শিল্প একদিন না একদিন যেসব কারণে শুকিয়ে যায়... প্রযুক্তির পুরোনো হয়ে যাওয়া ও তাও তাকে আঁকড়ে ধরে থাকানতুন বিনিয়োগের অভাবপ্রতিযোগিতার বাজারে একসময়ের একচেটিয়া আধিপত্যের অবসান ও কর্মসংস্কৃতি-বিচ্ছিন্ন ট্রেডইউনিয়ন আন্দোলন ইত্যাদি। আশির দশকের শেষ আর নব্বই দশকের শুরুএই পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে শিল্পগুলির আপাত রোশনাইয়ের নীচে প্রচ্ছন্ন নাভিশ্বাসগুলো সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে সামনে চলে এল। যে কারখানাগুলো বন্ধ হল নাসেগুলোর মালিকানা বদল হল। এবং বদলের পরেই বিপুল সংখ্যক শ্রমিক ছাঁটাই। কন্ট্রাক্ট লেবার কথাটা তখন প্রথম শুনলাম। সংসারে তখনও প্রয়োজন ছিলযতীনকাকার ছোট ছেলে তখনও ক্লাস ফোর। যতীনকাকা খুব অনিচ্ছার সঙ্গে টিটাগড়ে নিজের বন্ধ কারখানার সামনের ফুটপাতে গামছার দোকান খুলে বসলেন। অবশ্য বেশিদিন করতে হয়নি সেই অনিচ্ছার কাজ। ব্রেইনস্ট্রোক।

আমরা বড় হতে থাকলাম আর আমাদের চোখের সামনে আশেপাশে আমাদেরই আগের প্রজন্ম ব্যর্থতায় হতাশায় কুঁকড়ে ছোট হয়ে যেতে লাগল। তারপর কিছুদিন চায়ের দোকানে বেঞ্চের প্রান্তে, বৈকালিক তাসের আড্ডায়, রেশনের লাইনে ব্যাগ হাতে প্রেতের মতো দেখা যেত এইসব ক্ষয়াটে মানুষদের। এরপর কবে যেন তাঁরা অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আজও মাঝে মাঝে সেইসব রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরিটিমটিমে আলো আধো অন্ধকারে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে কিছু কারখানাআর কারখানার মৃতদেহের ওপর গড়ে তোলা কিছু আধুনিক টাউনশিপ। বঙ্গশ্রীহিন্দ মোটররোহিনী মিলের জায়গায় আজ গোডরেজগ্র‍্যান্ড সিটিজেনেসিস। লাইফস্টাইল লিভিংজিমসুইমিং পুলসেভেনটি পারসেন্ট গ্রিনারি। অন্য রূপকথা। কালের নিয়মে বদলে গেছে আমাদের মফস্বল। এখন আর সকালে উঠে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে না কেউ। পাশের বাড়ি থেকে রেওয়াজ করার শব্দ আসে না আর। বরং টিভি খুললেই ভেসে আসে ফ্ল্যাট বেচার জন্য 'ধন ধান্য পুষ্প ভরা'-র অক্ষম প্যারডি। এর চেয়ে সময়োপযোগীএর চেয়ে পরিহাসময় বাস্তব আর কীই বা হতে পারে এই মুহূর্তে?

তবু রুটিটা গড়িয়েই চলেছে। অনেক মানুষ ছোঁয়ার চেষ্টা করছে সেটা। পারছে না। দুনিয়া জুড়ে বেড়ে চলেছে শাসক আর শাসিতের ব্যবধান। ক্ষোভ জমছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। যাঁরা নিজেরাই রুটি বানানরুটির নাগাল পাচ্ছেন না তাঁরাও। আমাদের দেশে হাজারো কৃষক পায়ে হেঁটে জমা হচ্ছেন নাসিকেমুম্বাইয়েদিল্লিতে।
রূপকথা বোধহয় পুরোপুরি শেষ হয়ে যায় না কোনওদিন।

                                                         

44 comments:

  1. অসাধারণ। পড়তে পড়তে বূক ভার। এমন স্মৃতি কথা পড়িনি বহুদিন। রূপকথায় প্রবেশ ও রূপকথা থেকে নিষ্ক্রমণ, এই রূপকথা কীভাবে ফিরে আসবে জানা নেই। এই কথন উপন্যাস হয়ে উঠুক। মহৎ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপ্লুত। আপনি এই সামান্য লেখাটা এত মন দিয়ে পড়েছেন ও মতামত দিয়েছেন, এটা সত্যিই খুব বড় পাওয়া।

      Delete
  2. খুব ভালো লেখা দেবব্রত। অপূর্ব!

    ReplyDelete
    Replies
    1. উৎসাহ পেলাম দাদা। অনেক অনেক ধন্যবাদ।

      Delete
  3. পড়তে পড়তে আমি আমার সেই কলোনি জীবনে ফিরে গেলাম।ভোর রাতের সেই রঙ কলের ঘণ্টা, বাসন্তি বা বঙ্গোদয় মিলের সাইরেন। পাখির ডাক। কলোনির জেগে ওঠা। চোখে জল এসে গেল।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অসংখ্য ধন্যবাদ, স্যার।

      Delete
  4. চমৎকার। যেকোন স্মৃতি-পাঠে এক ভালোলাগা লেপ্টে থাকে শেষ অবধি। তোমার গদ্যের হাত সাদা ভাতের মতই সুস্বাদু। শুধু শেষে এসে মনে হল,গরম রুটি যদি আরো একটু পাওয়া যেত ক্ষিদের মুখে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. বুঝেছি তুমি কী বলতে চাইছ। আন্তরিক ধন্যবাদ। :)

      Delete
  5. অসামান্য লেখা। অনবদ্য লেখা। যে কথা গুলো ভাবতেও ভয় লাগে, পাছে আপাত নিরুপদ্রব জীবনে বিবেকের কামড় লাগে বলে, সেই কথা গুলো উঠে এসেছে। রূপকথার রূপকের ব্যবহার খুব সুন্দর লেগেছে। এ গল্পগুলো আমার মত আমার বয়সের অনেকেরই এখনো মুখস্ত। আজও মাথার মধ্যে খেলা করে বেড়ায়। এবং মনে প্রানে বিশ্বাস ধরে রাখতে সাহায্য করে, যে আসবেই একদিন, যেদিন ওই রূপকথার দেশ আবার আমরা গড়ে তুলব এই পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো সভ্যতার দেশে। লাল সেলাম।

    ReplyDelete
    Replies
    1. খুব ভালো লাগলো লেখাটা। একটা সময়ের নিখুঁত ছবি।

      Delete
    2. লেখাটি এত মন দিয়ে পড়েছেন আর ভালো লেগেছে জেনে আনন্দ হচ্ছে। অনেক ধন্যবাদ।

      Delete
  6. আপনার কলমের মুন্সীয়ানার দৌলতে আমারো ছেলেবেলার বেশ কিছু সময়ের যেন ছোঁয়া পেলাম। স্মৃতির সরণি বেশ মসৃণ না হলেও আপনার কলমের জাদুতে ভ্রমণটি খুব ভাল হল। বিপ্লব কখনো ব্যর্থ হয়না, তাই আপনার সোভিয়েত সমান্তরাল বিপ্লবে আপনি জয়ী হয়েছেন। অত্যন্ত সুখপাঠ্য আর স্মৃতিমেদুর লেখা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমাদের অনেকের ছেলেবেলা দেখছি একইসূত্রে গাঁথা, অনেক বেমিল থাকা সত্ত্বেও। আসলে যেটা আমাদের বাঁধে সেটা জাত নয়, ধর্ম নয়, অন্য কিছু। :) ভালো লাগল।

      Delete
  7. ছোটবেলার কথা সেভাবে মনে করার আর সুযোগ হয়না আজকাল, আপনার সুবাদে হল । আপনার ছোটবেলার সাথে আমারটার আপাত-অমিল অনেক, আবার, সব ছোটবেলাই হয়ত শেষপর্যন্ত কোথাও একটা গিয়ে মেলে । এই রকম একটা মনে-পড়ানো লেখা লিখে ফেলা সোজা কথা নয় । আপনি লিখে চলুন, আমাদের অনেক কিছুই হয়ত মনে পড়বে যা মনে পড়ার কথা ছিল, কিম্বা, হয়ত বা ছিল না ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনারা এইভাবে উৎসাহ দিলে না লিখে পারা যাবে না। অনেক ধন্যবাদ, দাদা!

      Delete
  8. স্মৃতি ও স্বপ্ন দিয়েই তৈরি হোক বাস্তব!

    ReplyDelete
  9. অনেক ধন্যবাদ! :)

    ReplyDelete
  10. মন-কেমন-মুগ্ধতার রঙ লেগে আছে এ-লেখার শরীরে। প্রজন্মের দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেলাম গড়িয়ে চলা আশমানি রুটির চলনে। অনবদ্য, সহজ, সুন্দর!

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা জানবেন।

      Delete
  11. রূপকথা আর তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা চুপকথা, এ দুয়ের অসামান্য যুগলবন্দি, মসৃণ চলন। ছুঁয়ে গেল মন, ছুঁয়ে গেল আমার শৈশব-কৈশোর, ছুঁয়ে দিল বর্তমান। এভাবেই রুটির গল্প রূপকথা হয়ে চলতেই থাকে অনন্তকাল; আসলে বাস্তব আর পরাবাস্তব আলাদা করাই মুশকিল। এরকম তীব্র মোহে আবিষ্ট অনুভূতি আর সম্পূর্ণ মোহমুক্ত দৃষ্টির লেখা আমায় বরাবরই প্রচণ্ড টানে।

    ReplyDelete
  12. অনেক ধন্যবাদ, প্রিয় পাঠক। ভালোবাসা নেবেন।

    ReplyDelete
  13. কী বলব! বলব দেবব্রত খুব ভালো লিখেছ? লেখাটা তো ভালো বটেই, কিন্তু তাতে কী বা বলা হয়! রূপকথা হারানোর যন্ত্রণা, যেটা আমরা সময়ের জাতক বহন করে চলেছি তার কী হবে! খোলা বাজারে যখন তোমার আমা, আমাদের রূপকথা বিকোয় স্মৃতির দামে তখন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে যে এখনও নিশ্চয়ই কেউ স্বপ্ন দেখে ছিলাটান হয়ে ওঠে ঘুমের থেকে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. সত্যি। যন্ত্রণাটা শেয়ার করা, আর কিছু নয়।

      Delete
  14. অসম্ভব ভালো লাগলো। আমাদের কৈশোরের আলোর ঝলক এই পড়ন্ত বিকেলে একটু ব্যথাময় হলেও আপনাকে ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  15. মহৎ স্মৃতিচারণা, যা এককথায় আমাদের, অর্থাৎ ষাটের শেষপর্ব আর সত্তরের প্রজন্মের ফেলে আসা রূপকথার আখ্যান। বাস্তব যতই মারুক, এ রূপকথা থেকে আমাদের কোনোদিনই নিষ্কৃতি নেই। নিষ্কৃতি চাইও না...

    ReplyDelete
    Replies
    1. দারুণ বললেন। ভালোবাসা নেবেন।

      Delete
  16. রূপকথা আর তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা চুপকথা, এ দুয়ের অসামান্য যুগলবন্দি, মসৃণ চলন। ছুঁয়ে গেল মন, ছুঁয়ে গেল আমার শৈশব-কৈশোর, ছুঁয়ে দিল বর্তমান। এভাবেই রুটির গল্প রূপকথা হয়ে চলতেই থাকে অনন্তকাল; আসলে বাস্তব আর পরাবাস্তব আলাদা করাই মুশকিল। এরকম তীব্র মোহে আবিষ্ট অনুভূতি আর সম্পূর্ণ মোহমুক্ত দৃষ্টির লেখা আমায় বরাবরই প্রচণ্ড টানে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ। আমরা তো প্রত্যেকেই কোনও না কোনওভাবে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত।

      Delete
  17. খিদের চেয়ে সৎ অনুভূতি কিছু জানা নেই। পৃথিবী জুড়ে একদিন যৌথ খামার হবে কি না জানি না। তবু সেই আশাতে বেঁচে থাকি।

    ReplyDelete
  18. আপনার লেখা টি পড়ে অভিভূত হলাম।হিন্দোল বাবুর টাইম লাইনে দেখে আমি লেখা টি পড়তে শুরু করি।রূপকথা মানে আমার কাছে ঠাম্মার অর্ধস্ফুট ঘুমন্ত শব্দের আকুতি ছিল।কিন্তু আপনার এ রূপকথা হৃদয়কে ঘা মেরেছে বারবার।একটা দশক কে কেউ এভাবে যে রূপকথার অন্য আদলে তুলে আনতে পারে ভাবতেই পারিনি।খুব ভালোলাগা লেগে র‌ইল।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভালোবাসা নেবেন, প্রিয় পাঠক। সম্মানিত বোধ করছি।

      Delete
  19. শুধু ভাল লাগা নয়, আরো বেশি কিছু। গর্ব হচ্ছে, এরকম লেখা এখনো তৈরী হচ্ছে! চলুক। এভাবেই।

    ReplyDelete
  20. অনেক ধন্যবাদ। কী যে বলি!

    ReplyDelete
  21. স্বপ্নরা ফিরে ফিরে আসে

    ReplyDelete
  22. যদিও একটি মারাত্মক ভুল আছে-- রুশদেশের উপকথা-র অসামান্য অনুবাদটি সুপ্রিয়া ঘোষের। সম্পাদনা : ননী ভৌমিক।

    ReplyDelete
  23. তথ্যটির জন্য ধন্যবাদ। তিরিশ বছর আগে পড়া বইটি, তাই ভুল হয়েছে সম্ভবত৷ যাই হোক, ভুল ভুলই। ধরিয়ে দিয়ে খুব ভালো করেছেন। তবে আশা করি, লেখাটির স্পিরিট ক্ষুন্ন হয়নি।

    ReplyDelete
  24. তা হয়নি। লেখাটি নিঃসন্দেহে উচ্চতায় পৌঁছেছে।

    ReplyDelete
  25. অসাধারণ বললে বড় সাধারণ বলা হয়।

    ReplyDelete
  26. অসাধারণ! ভালোলাগা বোঝানোর ভাষা নেই। স্তব্ধ করে দেওয়া লেখা!

    ReplyDelete

এক ঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে